পোস্টগুলি

জুন, ২০২০ থেকে পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে

সঙ্গোপনে ১২

নববর্ষের দিন চিত্রাকে বলেছিলাম, ‛সবাই সাদা শাড়ি পড়েছে আজকে। আর তুমি পড়লা নীল শাড়ি?’ চিত্রা খুব জোরে হেসে বলেছিলো, ‛আমি কিন্তু জানি, তুমিও মনে মনে খুব চেয়েছো আমি নীল শাড়িটাই পড়ি।’ আমি কোনো জানি সেদিন আর কিছুই বলতে পারলাম না। সত্যিই তো; আমি সবসময় চাইতাম আমার দেওয়া নীল শাড়িটা পড়ুক চিত্রা। তবুও ঠিক করেছিলাম, চিত্রাকে লাল পাড়ের একটা সাদা শাড়ি কিনে দিবো। আবার নববর্ষ আসলে পড়বে। চুলগুলো খোঁপা করলে একটা রক্তজবা গেঁথে দিবো। বাঙালি নারীদেরকে নববর্ষে এই সাজটাতে ভালো মানায়। কিন্তু আজ নববর্ষ না। নাকি নববর্ষ? চিত্রার জন্য? লাল পাড়ের সাদা একটা শাড়িতেই দেখছি চিত্রাকে। চন্দন কাঠে সাজানো চিতায় শুয়ে আছে। কিন্তু চুলে কোনো রক্তজবা গাঁথা নেই। চিত্রার খোঁপায় রক্তজবা গেঁথে দেওয়ার ইচ্ছেটা অপূর্ণই রয়ে গেলো? পশ্চিমে লাল আভাটুকু রেখে সূর্য ডুবে গেছে। শান্ত নদীতে পানকৌড়ির দল অবিরাম ছুটে চলেছে। করতোয়ার এইটুকু পাড়ে আলো, অনেক আলো; বাকি থাকা আমার অর্ধেক প্রেম পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে!

সঙ্গোপনে ১১

প্রেমের মধ্য দিয়ে একটা মানুষের খুব কাছে যাওয়া যায়। একটা মানুষকে জয় করা যায়। কিন্তু পৃথিবী জয় করা যায় না। বাস্তবতা ভিন্ন জিনিস। বেখেয়ালি প্রেম পৃথিবী মেনে নেয় না! সেদিন হাসপাতালে চিত্রা আর চোখ খুলে নি। মরদেহটা বীরগঞ্জে এনে সৎকার করতে চেয়েছি। শালবনে কবিতা ছাপানোর খাতিরে আমাকে চিনে অনেকে। সেই সূত্র ধরেই টোটনের জন্ম এবং চিত্রার মৃত্যুর খবর শিবরামপুরে পৌঁছে যায়। হরিরাজ ব্যানার্জি ছুটে আসেন। আমার প্রেমের কথা তিনি শুনতে চান নি। আমার আর চিত্রার মধ্যে কোনো বৈধতার দলিল ছিলো না। রুপম বাবুও চলে যাবার সময় বিচ্ছেদের দলিল রেখে যান নি। চিত্রার আমার প্রেমের কথা কাউকে বিশ্বাস করাতে পারি নি। আমাদের প্রেমে সাক্ষী ছিলো আকাশ, পাখি, মাছ। সাক্ষী ছিলো প্রকৃতি। রুপম বাবু ছাড়া আর কোনো মানুষ সাক্ষী ছিলো না। মানুষের সাক্ষী ছাড়া সম্পর্ককে বাস্তবতা মেনে নেয় না। রুপম বাবুকে পাই নি আর। কলকাতায় গিয়ে সবার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন। তিনি থাকলে শেষবারের মতো অন্তত আমাদের প্রেমকে বাঁচিয়ে দিতে পারতেন! চিত্রাকে রাখা হয়েছিল আমারদের জঙ্গলে ঘেরা বাড়িটির উঠোনে। টোটন ছাড়া আর কোনো মানুষের কান্না ছিলো না সেখানে। হটাৎ দ...

সঙ্গোপনে ১০

করতোয়ার পাড়ে আগে কখনো আসেনি চিত্রা। শান্ত নদী। একটু পর গোধূলি পেরিয়ে যাবে। একদল ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আমার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। এদের বেশ একদম আমার শৈশবকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। কারো কারো গায়ে জামা নেই। উস্কোখুস্ক চুল অনেকের। হাতে ইট পাথর। কারো কারো হাত ফাঁকা হয়ে গেছে। আমি করতোয়ার পাড়ে এসে থামতে, এরাও থমকে গেছে। যেনো ভিন্ন কিছু দেখছে! চিত্রা এসেছে লাল মোটা পাড়ের সাদা শাড়িতে। অদূরে করতোয়ার ভাঙ্গন নদীর পাড়ে। আমি চিনি এ জায়গা। হাসপাতালের সেই অদ্ভুত স্বপ্নে আমাদের লাল গরুটা ক্ষেপে গিয়ে এখানেই চিত্রাকে ফেলে দিতে চেয়েছে। চিত্রা সাঁতার জানে না। আমার ডাকতে ইচ্ছে হয়, ‛চিত্রা?’ কাছে যেতে ইচ্ছে হয়। ছুঁতে ইচ্ছে হয়। বাকি থাকা আমার অর্ধেক প্রেম চাইতে ইচ্ছে হয়। আমি পারি না। দূর থেকে দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারি না। কেনো এমন হলো?

সঙ্গোপনে ৯

অপারেশন থিয়েটারের সামনে লাল বাতি। ভেতরে চিত্রার ডেলিভারি অস্ত্রোপচার চলছে। কিছুক্ষন আগেও একজন ডাক্তারকে ছুটোছুটি করে ভেতরে ঢুকতে দেখেছি। আমার এখানে অবস্থান নিষেধ। তবুও মন মানছে না। ব্লাড ব্যাংক থেকে আসতে আসতে এইটুকু সময়ের মধ্যে চিত্রাকে ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলেছে। রক্তের ব্যাগ দুটো ভেতরে দিয়ে নার্স যখন বের হলো, আমি পথ আটকে ধরেছিলাম। বললাম, ‛আমার চিত্রা?’ নার্সের চোখে চিন্তার ছাপ ছিলো। বললো, ‛কন্ডিশন সিরিয়াস। এখনি অস্ত্রোপচার হবে।’ আমি সামনের লাল বাতিটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। নার্স বলে গেলো, ‛আপনি একটু ওয়ার্ডে গিয়ে দাঁড়ান, নয়তো বাইরে দাঁড়ান। দরকারে ডাক দেবো। এখানে থাকলে ঢুকতে বেরোতে সমস্যা।’ নার্সের কথাগুলো কানে নেই নি। আমি তবুও দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি জানি, অপারেশন থিয়েটারে ঢুকার আগে চিত্রা আমাকে খুঁজেছে। কিছু বলতে চেয়েছে। আমার হাতটা শক্ত করে ধরতে চেয়েছে। চিত্রার কি এখন জ্ঞান আছে? জ্ঞান থাকলে নিশ্চয় আমাকে খুঁজবে। ও ভয় পায়। খুব বেশি ভয় পায়। এজন্য আমাকে সবসময় কাছে চায়। আমি যেতে চাই। সামনের এই কাঁচের দরজাটা ভেঙে হলেও চিত্রার কাছে যেতে চাই। বলতে চাই; চিত্রা তোমার মিহির আছে, আর কোনো ভয় নেই। সামনে...

সঙ্গোপনে ৮

হাসপাতালে কান্নাকাটি কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার না। সারাদিনই এদিক সেদিক থেকে কান্নার আওয়াজ আসে। চিত্রার ওয়ার্ডের সামনে যেতেই বুকটা ধপ করে উঠে। এতো চিত্রার কান্নার আওয়াজ! দৌড় দিলে আমার জুতোর শব্দে কান্নার আওয়াজ ঢাকা পড়ে যায়। চিত্রা বেডের সিট দুহাতের নখ দিয়ে আঁকড়ে ধরে রাখছে। বন্ধ চোখে চোয়াল শক্ত করে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে। তবুও কান্নার আওয়াজ বের হচ্ছে মুখ দিয়ে মাঝে মাঝে। আমি দৌড়ে এসে চিত্রার হাত ধরে পাশে বসি। সামনে নার্স দাঁড়িয়ে আছে। বললো, ‛ভাই প্রসবব্যথা।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‛কি করবেন এখন আপনারা?’ ‛অপারেশন থিয়েটারে নিতে হবে।’ ‛তো নেন? কখন নিবেন?’ ‛ডাক্তার আসলে বলতে পারবো ভাই। একটু বসেন।’ ‛এতক্ষন ও এভাবে কষ্ট পাবে? এখনি নিয়ে যাওয়া যায় না?’ নার্স কেমন অসহায়ত্বের চোখে তাকালো। বললো, ‛পেশেন্ট আছে তো ভাই ভেতরে। এখানে সিরিয়াল থাকে একজনের পর একজনের।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‛চিত্রার সিরিয়াল কখন?’ ‛সিরিয়াল বলতে বিকেলে নিবে ডাক্তার বলে গেছে। আজকে তো পেশেন্টের ডেলিভারি ডেট। নরমালি আমরা প্রসবব্যথা উঠানোর জন্য পেশেন্টকে ইনজেকশন দেই অস্ত্রোপচারের আগে। কিন্তু আপনার পেশেন্ট এখনি সিরিয়াস কন্ডিশনে চলে য...

সঙ্গোপনে ৭

হাসপাতালের দেয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং শব্দ। রাত ঠিক বারোটা। ভোরের আলো ফুটতে আরো অনেকটা সময় বাকি। তবুও ক্যালেন্ডারে তারিখের ঘরটা পাল্টে গেছে। নতুন দিনের শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু দিনের কার্যক্রম শুরু হবে ভোরের আলো ফোটার পরে। আমাকেও অপেক্ষা করতে হবে বাকি সময়টুকু এখানে। মানুষ আছে আশেপাশে অনেকে। সবাই অপরিচিত। যারা রাত জেগে আছে, সবার চোখেই ক্লান্তির ছাপ। চাইলেই কারো সামনে গিয়ে নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করে পরিচিত হবার সুযোগ নেই। বিরক্ত হবে। তবুও ইচ্ছে করছে জেগে থাকা সবার সাথে গিয়ে কথা বলি। সখ্যতা হয়ে গেলে শেষে রক্তের গ্রূপটা জিজ্ঞেস করবো। খুব দরকারি প্রশ্ন। রক্তের গ্রূপ নিয়ে কেউ নিশ্চয় মিথ্যে বলবে না। কারো কাছে এ নেগেটিভ রক্ত পেয়ে গেলেই হলো। প্রয়োজনে হাতে পায়ে ধরবো আমার চিত্রার জন্য। চিত্রার রক্তের গ্রূপ এ নেগেটিভ। কালকে সকালের মধ্যে লাগবে। ওয়ার্ডে গেছিলাম সন্ধ্যায়। ডাক্তার এসেছিলেন আবার। বললেন, ‛কমপক্ষে দুই ব্যাগ রক্ত জোগাড় করে রাখবেন। বলা তো যায় না।’ মনে পড়লো এখনি ব্লাড ব্যাংকে যেতে হবে। উঠতে চাইলে চিত্রা বললো, ‛কোথায় যাবা রাত করে। ব্লাড ব্যাংক চিনো?’ ‛চিনি না তো। দেখি কাউকে জিজ্ঞেস করে নিবো নে।’ আবার ...