সঙ্গোপনে ১১
প্রেমের মধ্য দিয়ে একটা মানুষের খুব কাছে যাওয়া যায়। একটা মানুষকে জয় করা যায়। কিন্তু পৃথিবী জয় করা যায় না। বাস্তবতা ভিন্ন জিনিস। বেখেয়ালি প্রেম পৃথিবী মেনে নেয় না!
সেদিন হাসপাতালে চিত্রা আর চোখ খুলে নি। মরদেহটা বীরগঞ্জে এনে সৎকার করতে চেয়েছি। শালবনে কবিতা ছাপানোর খাতিরে আমাকে চিনে অনেকে। সেই সূত্র ধরেই টোটনের জন্ম এবং চিত্রার মৃত্যুর খবর শিবরামপুরে পৌঁছে যায়। হরিরাজ ব্যানার্জি ছুটে আসেন। আমার প্রেমের কথা তিনি শুনতে চান নি। আমার আর চিত্রার মধ্যে কোনো বৈধতার দলিল ছিলো না। রুপম বাবুও চলে যাবার সময় বিচ্ছেদের দলিল রেখে যান নি। চিত্রার আমার প্রেমের কথা কাউকে বিশ্বাস করাতে পারি নি। আমাদের প্রেমে সাক্ষী ছিলো আকাশ, পাখি, মাছ। সাক্ষী ছিলো প্রকৃতি। রুপম বাবু ছাড়া আর কোনো মানুষ সাক্ষী ছিলো না। মানুষের সাক্ষী ছাড়া সম্পর্ককে বাস্তবতা মেনে নেয় না। রুপম বাবুকে পাই নি আর। কলকাতায় গিয়ে সবার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন। তিনি থাকলে শেষবারের মতো অন্তত আমাদের প্রেমকে বাঁচিয়ে দিতে পারতেন!
চিত্রাকে রাখা হয়েছিল আমারদের জঙ্গলে ঘেরা বাড়িটির উঠোনে। টোটন ছাড়া আর কোনো মানুষের কান্না ছিলো না সেখানে। হটাৎ দেখি হৈচৈ। দলবল নিয়ে হরিরাজ ব্যানার্জি হাজির। এসেই চেঁচিয়ে বলেন,
‛আমার নাতি কই?’
আমি কিছু বুঝার আগেই টোটনকে আমার কোল থেকে নিজের দখলে নিয়ে নেন। একরকম কাড়াকাড়িতে আমি বলে উঠি,
‛টোটন আমার ছেলে।’
আমার কথা সিরিয়াসলি কানে নেন না হরিরাজ ব্যানার্জি। বলেন,
‛রূপমের খবর নেই। ছেলের বউটাও মারা গেলো। এখন আমার নাতিটারে নিয়া তুমি কাড়াকাড়ি করবা?’
‛বিশ্বাস করেন আপনি, টোটন সত্যি আমার ছেলে।’
হরিরাজ ব্যানার্জি চেঁচিয়ে উঠেন,
‛আমার ছেলে, আমার ছেলের বউ, এই বাচ্চা তোমার হয় কেমনে?’
আমি নিঃশব্দে মাথা নিচু করে ফেলি। বলি,
‛রুপম বাবু কলকাতায় যাবার পর চিত্রা আমি একসাথে ছিলাম।’
কথা শেষ হতেই দেখি সজোরে এক লাথি একদম আমার পেটে। নিচে পড়ে যাই। উঠে দাঁড়ানোর শক্তি হারিয়ে ফেলি। পড়ার আগে হরিরাজ ব্যানার্জির কথাগুলো শুনতে পাই।
‛হারামজাদা। আমার মরা ছেলের বউটার নামে বদনাম রটানোর সাহস কে দিছে তোরে?’
উঠতে পারি না। মাটিতে গড়িয়েই বলি,
‛চিত্রা আমাকে ভালোবাসতো। রুপম বাবু জানেন সব।’
হরিরাজ ব্যানার্জি আবার সামনে আসেন। বলেন,
‛রুপম আছে কই? রূপমরে খবর দে।’
‛রুপম বাবু কলকাতায় চলে গেছেন। আর যোগাযোগ হয় নি।’ বলি আমি।
হরিরাজ ব্যানার্জি সন্দেহের চোখে শাসিয়ে বলেন,
‛সব তোর মিথ্যা বানোয়াট কথা।’
আরো দুজন লোক এসে দাঁড়ায় সামনে। একজন বলে,
‛মারমু নাকি শালারে?’
হরিরাজ ব্যানার্জি কিছু বলার আগেই অন্যজন লাথি মারে একদম ঠিক বুকে। শ্বাসনালি প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। চোখে কিছু দেখি না। দুজোড়া পা দিয়ে লাথির আঘাত সারা শরীরে পড়তে থাকে। আমার কেউ এগিয়ে আসে না ভয়ে। হরিরাজ ব্যানার্জি এমনি একজন মানুষ, বনে সিংহের দলপাতি; হরিরাজ যেমন হয়!
নিজেকে খানিকটা সামলাতে দেখি, টোটনের কান্নার শব্দ আর নেই। উঠোন খালি, চিত্রাও নেই! আমি দৌড় দেই সোজা শিবরামপুরের দিকে। লোকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ছেড়া পোশাকে উস্কোখুস্ক চুলের রক্তাক্ত একজন মানুষ চিৎকার ফেরি করে দৌড়াচ্ছে। বাতাসে শুধু উচ্চস্বরে একটা চিৎকারই ভেসে বেড়াচ্ছে,
‛চিত্রা!’
একসময় শক্তি ফুরিয়ে আসে। পায়ে ব্যাথা অনুভূত হয়; খুঁড়িয়ে হাটি। চোখের পানি মিশে যায় নাক দিয়ে বেয়ে পড়া রক্তে! গ্রামের ছোট ছোট ছেলে মেয়ে পিছু নেয়। হাসাহাসি করে। পেছন থেকে ইট পাথর মারে। আমি তবুও হেঁটে চলি সামনে। চিত্রার কাছে পৌঁছাতে হবে। চিত্রাকে শিবরামপুরে পাই না। শুনি; সৎকারের জন্য করতোয়ার পাড়ে নিয়ে গেছে। করতোয়ার পাড় ঘেঁষে ছুটে চলি সামনে। এ আমার ভীষণ চেনা পথ; সবটা মনে পড়ে লিখে রাখা কবিতায়!
সেদিন হাসপাতালে চিত্রা আর চোখ খুলে নি। মরদেহটা বীরগঞ্জে এনে সৎকার করতে চেয়েছি। শালবনে কবিতা ছাপানোর খাতিরে আমাকে চিনে অনেকে। সেই সূত্র ধরেই টোটনের জন্ম এবং চিত্রার মৃত্যুর খবর শিবরামপুরে পৌঁছে যায়। হরিরাজ ব্যানার্জি ছুটে আসেন। আমার প্রেমের কথা তিনি শুনতে চান নি। আমার আর চিত্রার মধ্যে কোনো বৈধতার দলিল ছিলো না। রুপম বাবুও চলে যাবার সময় বিচ্ছেদের দলিল রেখে যান নি। চিত্রার আমার প্রেমের কথা কাউকে বিশ্বাস করাতে পারি নি। আমাদের প্রেমে সাক্ষী ছিলো আকাশ, পাখি, মাছ। সাক্ষী ছিলো প্রকৃতি। রুপম বাবু ছাড়া আর কোনো মানুষ সাক্ষী ছিলো না। মানুষের সাক্ষী ছাড়া সম্পর্ককে বাস্তবতা মেনে নেয় না। রুপম বাবুকে পাই নি আর। কলকাতায় গিয়ে সবার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন। তিনি থাকলে শেষবারের মতো অন্তত আমাদের প্রেমকে বাঁচিয়ে দিতে পারতেন!
চিত্রাকে রাখা হয়েছিল আমারদের জঙ্গলে ঘেরা বাড়িটির উঠোনে। টোটন ছাড়া আর কোনো মানুষের কান্না ছিলো না সেখানে। হটাৎ দেখি হৈচৈ। দলবল নিয়ে হরিরাজ ব্যানার্জি হাজির। এসেই চেঁচিয়ে বলেন,
‛আমার নাতি কই?’
আমি কিছু বুঝার আগেই টোটনকে আমার কোল থেকে নিজের দখলে নিয়ে নেন। একরকম কাড়াকাড়িতে আমি বলে উঠি,
‛টোটন আমার ছেলে।’
আমার কথা সিরিয়াসলি কানে নেন না হরিরাজ ব্যানার্জি। বলেন,
‛রূপমের খবর নেই। ছেলের বউটাও মারা গেলো। এখন আমার নাতিটারে নিয়া তুমি কাড়াকাড়ি করবা?’
‛বিশ্বাস করেন আপনি, টোটন সত্যি আমার ছেলে।’
হরিরাজ ব্যানার্জি চেঁচিয়ে উঠেন,
‛আমার ছেলে, আমার ছেলের বউ, এই বাচ্চা তোমার হয় কেমনে?’
আমি নিঃশব্দে মাথা নিচু করে ফেলি। বলি,
‛রুপম বাবু কলকাতায় যাবার পর চিত্রা আমি একসাথে ছিলাম।’
কথা শেষ হতেই দেখি সজোরে এক লাথি একদম আমার পেটে। নিচে পড়ে যাই। উঠে দাঁড়ানোর শক্তি হারিয়ে ফেলি। পড়ার আগে হরিরাজ ব্যানার্জির কথাগুলো শুনতে পাই।
‛হারামজাদা। আমার মরা ছেলের বউটার নামে বদনাম রটানোর সাহস কে দিছে তোরে?’
উঠতে পারি না। মাটিতে গড়িয়েই বলি,
‛চিত্রা আমাকে ভালোবাসতো। রুপম বাবু জানেন সব।’
হরিরাজ ব্যানার্জি আবার সামনে আসেন। বলেন,
‛রুপম আছে কই? রূপমরে খবর দে।’
‛রুপম বাবু কলকাতায় চলে গেছেন। আর যোগাযোগ হয় নি।’ বলি আমি।
হরিরাজ ব্যানার্জি সন্দেহের চোখে শাসিয়ে বলেন,
‛সব তোর মিথ্যা বানোয়াট কথা।’
আরো দুজন লোক এসে দাঁড়ায় সামনে। একজন বলে,
‛মারমু নাকি শালারে?’
হরিরাজ ব্যানার্জি কিছু বলার আগেই অন্যজন লাথি মারে একদম ঠিক বুকে। শ্বাসনালি প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। চোখে কিছু দেখি না। দুজোড়া পা দিয়ে লাথির আঘাত সারা শরীরে পড়তে থাকে। আমার কেউ এগিয়ে আসে না ভয়ে। হরিরাজ ব্যানার্জি এমনি একজন মানুষ, বনে সিংহের দলপাতি; হরিরাজ যেমন হয়!
নিজেকে খানিকটা সামলাতে দেখি, টোটনের কান্নার শব্দ আর নেই। উঠোন খালি, চিত্রাও নেই! আমি দৌড় দেই সোজা শিবরামপুরের দিকে। লোকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ছেড়া পোশাকে উস্কোখুস্ক চুলের রক্তাক্ত একজন মানুষ চিৎকার ফেরি করে দৌড়াচ্ছে। বাতাসে শুধু উচ্চস্বরে একটা চিৎকারই ভেসে বেড়াচ্ছে,
‛চিত্রা!’
একসময় শক্তি ফুরিয়ে আসে। পায়ে ব্যাথা অনুভূত হয়; খুঁড়িয়ে হাটি। চোখের পানি মিশে যায় নাক দিয়ে বেয়ে পড়া রক্তে! গ্রামের ছোট ছোট ছেলে মেয়ে পিছু নেয়। হাসাহাসি করে। পেছন থেকে ইট পাথর মারে। আমি তবুও হেঁটে চলি সামনে। চিত্রার কাছে পৌঁছাতে হবে। চিত্রাকে শিবরামপুরে পাই না। শুনি; সৎকারের জন্য করতোয়ার পাড়ে নিয়ে গেছে। করতোয়ার পাড় ঘেঁষে ছুটে চলি সামনে। এ আমার ভীষণ চেনা পথ; সবটা মনে পড়ে লিখে রাখা কবিতায়!
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন