সঙ্গোপনে ৭
হাসপাতালের দেয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং শব্দ। রাত ঠিক বারোটা। ভোরের আলো ফুটতে আরো অনেকটা সময় বাকি। তবুও ক্যালেন্ডারে তারিখের ঘরটা পাল্টে গেছে। নতুন দিনের শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু দিনের কার্যক্রম শুরু হবে ভোরের আলো ফোটার পরে। আমাকেও অপেক্ষা করতে হবে বাকি সময়টুকু এখানে। মানুষ আছে আশেপাশে অনেকে। সবাই অপরিচিত। যারা রাত জেগে আছে, সবার চোখেই ক্লান্তির ছাপ। চাইলেই কারো সামনে গিয়ে নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করে পরিচিত হবার সুযোগ নেই। বিরক্ত হবে। তবুও ইচ্ছে করছে জেগে থাকা সবার সাথে গিয়ে কথা বলি। সখ্যতা হয়ে গেলে শেষে রক্তের গ্রূপটা জিজ্ঞেস করবো। খুব দরকারি প্রশ্ন। রক্তের গ্রূপ নিয়ে কেউ নিশ্চয় মিথ্যে বলবে না। কারো কাছে এ নেগেটিভ রক্ত পেয়ে গেলেই হলো। প্রয়োজনে হাতে পায়ে ধরবো আমার চিত্রার জন্য। চিত্রার রক্তের গ্রূপ এ নেগেটিভ। কালকে সকালের মধ্যে লাগবে। ওয়ার্ডে গেছিলাম সন্ধ্যায়। ডাক্তার এসেছিলেন আবার। বললেন,
‛কমপক্ষে দুই ব্যাগ রক্ত জোগাড় করে রাখবেন। বলা তো যায় না।’
মনে পড়লো এখনি ব্লাড ব্যাংকে যেতে হবে। উঠতে চাইলে চিত্রা বললো,
‛কোথায় যাবা রাত করে। ব্লাড ব্যাংক চিনো?’
‛চিনি না তো। দেখি কাউকে জিজ্ঞেস করে নিবো নে।’
আবার উঠতে চাইলে চিত্রা হাতটা ধরে রাখলো। বললো,
‛একটু পর যাও না। এখন গেলে তো আর সকালের আগে আর আসতে পারবা না এখানে।’
‛আরে আসবো নে দেখি। গেটের ওদের হাতে বিশ ত্রিশ টাকা দিলেই ঢুকতে দেয় ভেতরে দেখলাম।’
‛থাক ওসব লাগবে না। তুমি একবারে একটু পরেই যাও।’
চিত্রা এভাবে হাতটা ধরে রাখলো। আমারও কেমন হাতটা ছাড়িয়ে উঠতে মন চাইলো না। বললাম,
‛একা একা খুব মন খারাপ হয় তোমার তাইনা?’
‛প্রথম প্রথম হতো মন খারাপ। এখন হয় না। জেগে থাকলেও স্বপ্ন দেখি।’
‛দূর কি বলো। খোলা চোখে আবার স্বপ্ন আসে নাকি?’
‛আসে তো। মানুষের কোলে কতো সুন্দর সুন্দর বেবি দেখি। তখন আমি আমার বেবিটাকে নিয়ে ভাবি। জানো ও কতো দুষ্ট হইছে?’
চিত্রার চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, আমার শরীরে কোনো ক্লান্তি নেই। এইটুকু চাহনি আমার সমস্ত ক্লান্তি মুছে দিলো। ওর চোখে কতো সুন্দর স্বপ্ন। একটা অনাগত মানুষকে নিয়ে স্বপ্ন। একটা ছোট্ট সংসারের স্বপ্ন। বললাম,
‛না তো। তুমি বলো নি তো, ও যে দুষ্ট হইছে।’
‛শুনো তাহলে। আমি চোখটা একটু বন্ধ করতেই ও হাত পা নেড়ে নেড়ে খেলাধুলো শুরু করে দেয়।’
‛ওহ তাই? তুমি তাহলে ওর খেলা দেখো?’
‛আরে না। আমি চিন্তা করি, এই বেবি নিশ্চিত তোমাকে আমাকে ফাঁকি দিবে বড় হলে। সুযোগ পেলেই খেলতে বেরিয়ে পড়বে বাইরে।’
‛তো বাইরে যাবে না ও? খেলবে না?’
‛এই না। তুমি বাইরে যেতে দিলে তোমাকেও মারবো কিন্তু। ও সারাক্ষন আমার কাছে থাকবে।’
‛আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। ওর সাথে আমি আর তুমি বাসাতেই খেলবো তাহলে।’
‛হুম তা নাহয় খেলবো। তুমি শিখিয়ে দিও খেলা।’
কথা বলতে বলতেই হটাৎ চিত্রা আমার হাতটা ওর পেটের উপর রাখলো। বললো,
‛এই দেখো দেখো, আবার খেলছে দুষ্টটা।’
পেটের ভেতর বেবিটা নড়ছে বলে আমি অনুভব করলাম না। তবুও বললাম,
‛হ্যাঁ, ঠিক ধরছো। কত দুষ্ট হয়ে গেলো আমাদের বেবিটা।’
চিত্রার চোখ মুখে আনন্দ। মা হতে চলার আনন্দ। আমি ওর এই সুন্দর মুহুর্তটা নষ্ট করে দিতে পারি না। বসে রইলাম অনেক্ষন। শেষে বললাম,
‛আরে ছোট বাবু তো। একটু আধটু ফাঁকি দিলে দিবে। ও নাহয় খেলুক। তুমি একটু ঘুমাও হ্যাঁ?’
‛ওহ বুঝেছি। তুমি চলে যেতে চাইছো তাই না?’
‛যেতে তো হবে। দেখো সবাই কেমন তাকিয়ে আছে।’
‛তাকিয়ে থাকলে তোমার কি হ্যাঁ? তুমি থাকো আমার কাছে।’
‛এই না, যাই হ্যাঁ? দেখো আটটা বাজতে বেশি বাকি নেই।’
চিত্রা আমার হাতটা ছুড়ে ফেললো। বললো,
‛যাও তুমি। থাকা লাগবে না।’
অভিমান করুক চিত্রা। আমাকে তবুও বেরোতে হবে। আসার পথে ওয়ার্ডের নার্সকে জিজ্ঞেস করলাম,
‛আপা, ব্লাড ব্যাংকটা কোথায়?’
নার্স অন্যমনস্ক। কাজ করার ফাঁকে তবুও উত্তর দিলো,
‛হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংক?’
‛জী হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংক।’
হাত দিয়ে হাসপাতালের সামনের দিকটা দেখিয়ে বললো,
‛এইদিক দিয়ে বেরোলে দেখবেন শহীদ মিনার। ওখানে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দিবে বকশিবাজার রোডে ব্যাংক।’
‛আচ্ছা আপা, থ্যাংকস।’
নার্স আবার নিজের কাজে মন দিলো। সারাদিন অনেকেই এসে নানান প্রশ্ন করে। উত্তর পেলে সবাই ধন্যবাদ দিয়ে যায়। ধন্যবাদটা ওনাদের প্রাপ্য। কাউকেই ওয়েলকাম বলার প্রয়োজন নেই।
বহির্বিভাগ গেট দিয়ে বেরোলেই শহীদ মিনার। কিন্তু এই গেট রাতের বেলা বন্ধ থাকে। আবার ইমার্জেন্সি গেট দিয়েই বেরোতে হলো। সেই একই অবস্থা। মুমূর্ষু রোগী আর অ্যাম্বুলেন্সের ভিড়। আজ তবুও খারাপ লাগে নি। একটাও মৃত মানুষ চোখে পড়ে নি। মৃত মানুষ দেখতে ভালো লাগে না। বিলাপ করে একজন বয়স্ক মহিলাকে কাঁদতে দেখলাম। মনে হচ্ছে ভেতরে কেউ মারা গেছে। কান্নায় সুর আছে। শোকের কান্নায় আশ্চর্য রকমের এক ক্ষমতা থাকে। এক লাইনের সাথে আরেক লাইন ছন্দে মিলে যায়। সেজন্য শোকের কান্নায় কবিতা হয়!
শহীদ মিনারের কাছ দিয়ে যাওয়ার পথে পরশুদিনের চায়ের কথা মনে পড়লো। চায়ের দোকানের ছেলেটা আজকে ফুল হাতা শার্ট পড়েছে। একদম ঢিলেঢালা। ওর মাপের না শার্টটা। কেউ দিয়েছে হয়তো। কাছ দিয়ে যেতে দেখে বললো,
‛ভাই চা খাইবেন না?’
চাহনিতে মায়া আছে। আমার সেখানে মমতার হাত বাড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কাজ তো আছে। বললাম,
‛তুই আছিস না এখানে?’
‛ওস্তাদ দোকান খোলা রাখলে থাকমু।’
‛আচ্ছা থাক, আমি একটা কাজ সেরে আসতেছি।’
ছেলেটা মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। আশ্চর্য, এতোটা মমতা জন্মে গেছে ছেলেটার প্রতি, অথচ ওর নামটাই জানি না। এতো কথা হলো ওইদিন ওর সাথে। নামটাই জিজ্ঞেস করলাম না। কি ভাববে ছেলেটা। আমার এই এক স্বভাব। অনেকের সাথেই অল্পতে সখ্যতা হয়ে যায়। কিন্তু নাম জিজ্ঞেস করা হয় না। অথবা নাম মনে থাকে না। কেমন যেনো ব্যাপারটা। নাম জানা ছাড়াও মানুষের কাছের মানুষ হওয়া যায়। সে সম্পর্কেরও কোনো নাম থাকে না। মায়া মমতা মেশানো এরকম অনেক সম্পর্ক থেকে যায় বেনামে!
ব্লাড ব্যাংকে এ নেগেটিভ রক্ত নেই। এক ভদ্রলোক বললেন,
‛ভাই এ নেগেটিভ রক্ত ব্লাড ব্যাংকে সচারাচর পাওয়া যায় না। আত্মীয় স্বজন কেউ থাকলে খোঁজ নিয়ে দেখেন।’
আত্মীয় স্বজন কোথায় পাবো। কার কাছে যাবো রক্তের জন্য। অন্য ব্লাড ব্যাংকে গেলেও যে রক্ত পাবো, তার নিশ্চয়তা নেই। তাছাড়া চিনিও না অন্য কোনো ব্লাড ব্যাংক। দিনের বেলা হলে কিছু একটা করা যেতো। সারাটারাত তাহলে চিন্তায় কাটবে। সব কাজেই লেট করে ফেলেছি। রক্তের ব্যবস্থাটা আরো আগে করে রাখার দরকার ছিলো। নিজের উপর নিজেরই রাগ লাগছে। চা খেতে আর ইচ্ছে করলো না। শহীদ মিনারে নিজের প্রাইভেট টিউশনি নিয়ে গল্প করে মানুষকে উৎসাহ দেওয়ার কাজ ওই ভদ্রলোক আজও করছেন। আমার এখন মনে হয়, লোকটার পেশা মূলত টিউশনি না। এটা ওনার গল্পের টপিক। উনি আসলে একজন গল্পকার। গল্পকাররা খুব সাজিয়ে গুছিয়ে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলতে পারে। তাদের গল্পের ধরণ বাস্তবতার সাথে মিলে যায়। সেজন্য গল্পকারদের কথা মানুষ খুব কাছ থেকে আগ্রহ নিয়ে শুনে। নিজের জীবনের সাথে মিলে গেলে বাহবা দেয়। আবার মতাদর্শের পার্থক্য হলে সমালোচনা করে। তবুও গল্পকারদের স্বাধীনতা থাকে। গল্প বলবার স্বাধীনতা!
হাসপাতালে চলে এসেছি সোজা চিত্রার ওয়ার্ডের সামনে। চায়ের দোকানের ছেলেটা আমাকে আসতে দেখে নি। নিশ্চয় অপেক্ষা করেছে। আমি যাই নি। কিছুটা মন খারাপ হয়েছে। কিন্তু সম্পর্ক থেমে যায় নি। মায়ার সম্পর্ক থামে না। না পাওয়াতে ভালোবাসা কমে না। কিছু সম্পর্ক টিকেই থাকে দূরত্বে, পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় না পাওয়াতে!
মধ্যরাত তাই মানুষজন তেমন গল্প গুজব করছে না। যারা ঘুমানোর সুযোগ পায় নি, তারাই বসে আছে। কেউ বসেই দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখছে। আমার তেমন ঘুম আসছে না। দেয়ালে হেলান দিলে আরো বেশি খারাপ লাগে। চিত্রাও হয়তো ঘুমাবে না। গভীর দুঃখ আর গভীর আনন্দ; এই দুটো জিনিস মানুষকে ঘুমোতে দেয় না। গভীর আনন্দের খুব নিকটে আমি আর চিত্রা। আমাদের আরো একজন কাছের মানুষ হবে। আলো দিবে চিত্রার আমার সাজানো ছোট্ট সংসারে!
বছর পেরিয়ে তখন আবার শীতকাল। শহরে শীতটা সকাল বেলাতেই বেশি থাকে। চিত্রাকে তাই খুব সকালে উঠতে দেই না। আমি নিজেই উঠে চা বানাই। একটু রোদ উঠলে চিত্রাকে উঠিয়ে বেলকুনিতে নিয়ে যাই। বেলকুনির একপাশ দিয়ে এক চিলতে রোদ ঢুকে। চিত্রার মুখে কখনো সেই রোদ এসে পরে। এখন আর আগের মতো পিচ্চি দেখতে লাগে না। একটু পরিপক্কতা এসেছে চেহারায়। স্বভাব তবুও বাচ্চাদের মতো। আমি নিজের হাতে চায়ে টোস্ট ভিজিয়ে খাইয়ে দেই। চিত্রা বেলকুনিতেই বসে থাকে। আমি ক্যাম্পাসে যাই। চিত্রা স্কুলে যায় না। গর্ভকালীন ছুটি পেয়েছে ছয় মাস। বাসায় ফিরি বিকেলে। এই সময়টা চিত্রা রান্না করে। বাসায় ফিরলে দুজন একসাথে খাই। সন্ধ্যার আগে চিত্রাকে হাটতে নিয়ে যাই ছাদে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে সামান্য কষ্ট হয়। তাই একবারই উঠা হয় দিনে। লম্বা সময় ছাদে কাটাই দুজনে। রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াই। কিছুটা শীত লাগে সন্ধে নামার আগে। চিত্রার গায়ে চাদর জড়িয়ে দিতে গেলে বলে,
‛তোমার শীত লাগছে না?’
‛তেমন বেশি না। তুমি চাদরটা নাও। বেবিটার শীত লাগবে তো।’
‛এই শুনো না, শীত আমারও লাগছে খুব।’
‛হ্যাঁ, তো চাদরটা নাও না?’
‛না চাদর না।’
‛কি তাহলে?’
চিত্রা অনেকক্ষন তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টিতে। বলে,
‛জড়িয়ে ধরো না।’
কতো মানুষজন আশেপাশের ছাদে। তবুও চিত্রার এই ছোট্ট আবদারে আমি বোকা হয়ে যাই। বলি,
‛জড়িয়ে ধরলে শীত কমবে?’
‛হুম, দেখো তো। একটুও শীত থাকবে না।’
‛আসো।’
চিত্রার একপাশ চাদর দিয়ে ঢেকে দেই। তারপর আলতোভাবে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখে দেই। চিত্রা আমার বুক থেকে মাথা উঠায় না। বলে,
‛বেবিটা আমাদের প্রেম দেখছে তাই না?’
‛শুধু বেবিটা না, আশেপাশের সব মানুষ দেখছে।’
‛মানুষজন নামছে না কেনো বলো তো? সন্ধ্যা তো হলো।’
‛যতক্ষণ আমরা এভাবে জড়িয়ে থাকবো, ততক্ষণ কেউ নামবে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে কি করি।’
চিত্রা হটাৎ নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। বলে,
‛দূর সবাই কেমন তাকিয়ে আছে। চলো নীচে।’
নিচে নামতে অনেক সময় লাগে। চিত্রার শরীর অনেকটা ভারী হয়েছে। ধীরে ধীরে নামে। আমি হাতটা ধরে রাখি। নিচে নেমে নিজেই চা বানিয়ে বেলকুনিতে আসে। দুজনে গায়ে চাদর জড়িয়ে পাশাপাশি বসি। চা ঠান্ডা হয়ে যায়, খেয়াল থাকে না। চিত্রা বলে,
‛এই নাম রাখবা না বেবির?’
‛আগে তো দেখি কি বেবি হয়।’
‛আরে ছেলে বেবিই তো হবে। আমি জানি।’
‛আমি জানি তোমার মতো দেখতে মেয়ে বেবি হবে।’
চিত্রা ক্ষেপে যায়। বলে,
‛মেয়ে বেবি অনেক শান্ত হয়। আমার বেবিটা দুষ্ট বেশি, নড়াচড়া করে। ছেলেই হবে দেইখো।’
‛আচ্ছা টেস্ট করে দেখি?’
‛কিভাবে?’
‛হাসপাতালে যাই চলো কাল।’
হাসপাতালে যাবো বলতেই চিত্রার মুখটা কেমন চুপসে যায়। ছোট্ট ইনকাম আমাদের। সঞ্চয় নেই। বলে,
‛থাকুক না মিহির। ছেলে নাহয় মেয়ে একটা তো হবেই। হলেই দেখবো নে।’
‛বেশি কথা বলবা না তো। বেবির নাম ঠিক করতে হবে না?’
চায়ের কাপ টেবিলে রেখে চিত্রা আমার হাত ধরে। বলে,
‛ঠিক আছে, কাল যাবো হাসপাতালে।’
পরদিন যাই হাসপাতালে। আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টে আসে ছেলে বেবি হবে। রিপোর্টটা দেখানোর সময় চিত্রা ছিলো না ডাক্তারের সামনে। একটু সমস্যা আছে। বেবির পজিশন একটু নীচে। সমস্যা তেমন জোরালো না। অস্ত্রোপচার করে ডেলিভারি করাতে হবে, এই। চিত্রাকে তখন বলি নি কথাটা। বাসায় এসে চিত্রা ব্যাস্ত ছেলের নাম ঠিক করতে। আমি একটা নামও ঠিক করি নি। সম্পূর্ণ দায়িত্ব চিত্রার হাতে। মুসলিম রীতিতে আর হিন্দু রীতিতে নামের ধরণ আলাদা হয়। আমার তাতে আপত্তি নেই। চিত্রা ছেলের নাম ঠিক করে টোটন। আমি সকালে ডাক দেই ঘুম থেকে উঠতে।
‛এই টোটনের মা, উঠো না। বেলা তো অনেক হলো।’
বিছানায় বসে দুহাতে বাচ্চাদের ভঙ্গিতে চোখ ডলতে ডলতে বলে,
‛মা হয়ে গেলাম তাইনা মিহির?’
‛হও নাই, হওয়ার পথে আছো। আগে থেকে রিহার্সেল করতেছি।’
‛এই না। তুমি আমাকে চিত্রাই ডাকবা। টোটনের মা বলে তো বাইরের মানুষ ডাকবে। তুমি আলাদা, স্পেশাল। সবাই যা ডাকবে, তুমি তা ডেকো না তো।’
‛ঠিকআছে, মাই ডেয়ার চিত্রা। উঠো এবার চা ঠান্ডা হয়।’
চা দিয়ে টোস্ট ভিজিয়ে ভিজিয়ে আমি চিত্রার মুখে দেই। চাইলে ও নিজের হাতেই খেতে পারে। কিন্তু খাবে না। এই এক বাচ্চামি স্বভাব ওর। বেলা বাড়ে। এক চিলতে রোদ কখন পুরো বেলকুনিতে ছেয়ে যায়, খেয়াল থাকে না। মাঝে মাঝে চিত্রাকে বাসায় রেখে বেরোতে ইচ্ছে হয় না। তবুও বেরোতে হয়, রোজ একই নিয়মে!
‛কমপক্ষে দুই ব্যাগ রক্ত জোগাড় করে রাখবেন। বলা তো যায় না।’
মনে পড়লো এখনি ব্লাড ব্যাংকে যেতে হবে। উঠতে চাইলে চিত্রা বললো,
‛কোথায় যাবা রাত করে। ব্লাড ব্যাংক চিনো?’
‛চিনি না তো। দেখি কাউকে জিজ্ঞেস করে নিবো নে।’
আবার উঠতে চাইলে চিত্রা হাতটা ধরে রাখলো। বললো,
‛একটু পর যাও না। এখন গেলে তো আর সকালের আগে আর আসতে পারবা না এখানে।’
‛আরে আসবো নে দেখি। গেটের ওদের হাতে বিশ ত্রিশ টাকা দিলেই ঢুকতে দেয় ভেতরে দেখলাম।’
‛থাক ওসব লাগবে না। তুমি একবারে একটু পরেই যাও।’
চিত্রা এভাবে হাতটা ধরে রাখলো। আমারও কেমন হাতটা ছাড়িয়ে উঠতে মন চাইলো না। বললাম,
‛একা একা খুব মন খারাপ হয় তোমার তাইনা?’
‛প্রথম প্রথম হতো মন খারাপ। এখন হয় না। জেগে থাকলেও স্বপ্ন দেখি।’
‛দূর কি বলো। খোলা চোখে আবার স্বপ্ন আসে নাকি?’
‛আসে তো। মানুষের কোলে কতো সুন্দর সুন্দর বেবি দেখি। তখন আমি আমার বেবিটাকে নিয়ে ভাবি। জানো ও কতো দুষ্ট হইছে?’
চিত্রার চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, আমার শরীরে কোনো ক্লান্তি নেই। এইটুকু চাহনি আমার সমস্ত ক্লান্তি মুছে দিলো। ওর চোখে কতো সুন্দর স্বপ্ন। একটা অনাগত মানুষকে নিয়ে স্বপ্ন। একটা ছোট্ট সংসারের স্বপ্ন। বললাম,
‛না তো। তুমি বলো নি তো, ও যে দুষ্ট হইছে।’
‛শুনো তাহলে। আমি চোখটা একটু বন্ধ করতেই ও হাত পা নেড়ে নেড়ে খেলাধুলো শুরু করে দেয়।’
‛ওহ তাই? তুমি তাহলে ওর খেলা দেখো?’
‛আরে না। আমি চিন্তা করি, এই বেবি নিশ্চিত তোমাকে আমাকে ফাঁকি দিবে বড় হলে। সুযোগ পেলেই খেলতে বেরিয়ে পড়বে বাইরে।’
‛তো বাইরে যাবে না ও? খেলবে না?’
‛এই না। তুমি বাইরে যেতে দিলে তোমাকেও মারবো কিন্তু। ও সারাক্ষন আমার কাছে থাকবে।’
‛আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। ওর সাথে আমি আর তুমি বাসাতেই খেলবো তাহলে।’
‛হুম তা নাহয় খেলবো। তুমি শিখিয়ে দিও খেলা।’
কথা বলতে বলতেই হটাৎ চিত্রা আমার হাতটা ওর পেটের উপর রাখলো। বললো,
‛এই দেখো দেখো, আবার খেলছে দুষ্টটা।’
পেটের ভেতর বেবিটা নড়ছে বলে আমি অনুভব করলাম না। তবুও বললাম,
‛হ্যাঁ, ঠিক ধরছো। কত দুষ্ট হয়ে গেলো আমাদের বেবিটা।’
চিত্রার চোখ মুখে আনন্দ। মা হতে চলার আনন্দ। আমি ওর এই সুন্দর মুহুর্তটা নষ্ট করে দিতে পারি না। বসে রইলাম অনেক্ষন। শেষে বললাম,
‛আরে ছোট বাবু তো। একটু আধটু ফাঁকি দিলে দিবে। ও নাহয় খেলুক। তুমি একটু ঘুমাও হ্যাঁ?’
‛ওহ বুঝেছি। তুমি চলে যেতে চাইছো তাই না?’
‛যেতে তো হবে। দেখো সবাই কেমন তাকিয়ে আছে।’
‛তাকিয়ে থাকলে তোমার কি হ্যাঁ? তুমি থাকো আমার কাছে।’
‛এই না, যাই হ্যাঁ? দেখো আটটা বাজতে বেশি বাকি নেই।’
চিত্রা আমার হাতটা ছুড়ে ফেললো। বললো,
‛যাও তুমি। থাকা লাগবে না।’
অভিমান করুক চিত্রা। আমাকে তবুও বেরোতে হবে। আসার পথে ওয়ার্ডের নার্সকে জিজ্ঞেস করলাম,
‛আপা, ব্লাড ব্যাংকটা কোথায়?’
নার্স অন্যমনস্ক। কাজ করার ফাঁকে তবুও উত্তর দিলো,
‛হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংক?’
‛জী হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংক।’
হাত দিয়ে হাসপাতালের সামনের দিকটা দেখিয়ে বললো,
‛এইদিক দিয়ে বেরোলে দেখবেন শহীদ মিনার। ওখানে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দিবে বকশিবাজার রোডে ব্যাংক।’
‛আচ্ছা আপা, থ্যাংকস।’
নার্স আবার নিজের কাজে মন দিলো। সারাদিন অনেকেই এসে নানান প্রশ্ন করে। উত্তর পেলে সবাই ধন্যবাদ দিয়ে যায়। ধন্যবাদটা ওনাদের প্রাপ্য। কাউকেই ওয়েলকাম বলার প্রয়োজন নেই।
বহির্বিভাগ গেট দিয়ে বেরোলেই শহীদ মিনার। কিন্তু এই গেট রাতের বেলা বন্ধ থাকে। আবার ইমার্জেন্সি গেট দিয়েই বেরোতে হলো। সেই একই অবস্থা। মুমূর্ষু রোগী আর অ্যাম্বুলেন্সের ভিড়। আজ তবুও খারাপ লাগে নি। একটাও মৃত মানুষ চোখে পড়ে নি। মৃত মানুষ দেখতে ভালো লাগে না। বিলাপ করে একজন বয়স্ক মহিলাকে কাঁদতে দেখলাম। মনে হচ্ছে ভেতরে কেউ মারা গেছে। কান্নায় সুর আছে। শোকের কান্নায় আশ্চর্য রকমের এক ক্ষমতা থাকে। এক লাইনের সাথে আরেক লাইন ছন্দে মিলে যায়। সেজন্য শোকের কান্নায় কবিতা হয়!
শহীদ মিনারের কাছ দিয়ে যাওয়ার পথে পরশুদিনের চায়ের কথা মনে পড়লো। চায়ের দোকানের ছেলেটা আজকে ফুল হাতা শার্ট পড়েছে। একদম ঢিলেঢালা। ওর মাপের না শার্টটা। কেউ দিয়েছে হয়তো। কাছ দিয়ে যেতে দেখে বললো,
‛ভাই চা খাইবেন না?’
চাহনিতে মায়া আছে। আমার সেখানে মমতার হাত বাড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কাজ তো আছে। বললাম,
‛তুই আছিস না এখানে?’
‛ওস্তাদ দোকান খোলা রাখলে থাকমু।’
‛আচ্ছা থাক, আমি একটা কাজ সেরে আসতেছি।’
ছেলেটা মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। আশ্চর্য, এতোটা মমতা জন্মে গেছে ছেলেটার প্রতি, অথচ ওর নামটাই জানি না। এতো কথা হলো ওইদিন ওর সাথে। নামটাই জিজ্ঞেস করলাম না। কি ভাববে ছেলেটা। আমার এই এক স্বভাব। অনেকের সাথেই অল্পতে সখ্যতা হয়ে যায়। কিন্তু নাম জিজ্ঞেস করা হয় না। অথবা নাম মনে থাকে না। কেমন যেনো ব্যাপারটা। নাম জানা ছাড়াও মানুষের কাছের মানুষ হওয়া যায়। সে সম্পর্কেরও কোনো নাম থাকে না। মায়া মমতা মেশানো এরকম অনেক সম্পর্ক থেকে যায় বেনামে!
ব্লাড ব্যাংকে এ নেগেটিভ রক্ত নেই। এক ভদ্রলোক বললেন,
‛ভাই এ নেগেটিভ রক্ত ব্লাড ব্যাংকে সচারাচর পাওয়া যায় না। আত্মীয় স্বজন কেউ থাকলে খোঁজ নিয়ে দেখেন।’
আত্মীয় স্বজন কোথায় পাবো। কার কাছে যাবো রক্তের জন্য। অন্য ব্লাড ব্যাংকে গেলেও যে রক্ত পাবো, তার নিশ্চয়তা নেই। তাছাড়া চিনিও না অন্য কোনো ব্লাড ব্যাংক। দিনের বেলা হলে কিছু একটা করা যেতো। সারাটারাত তাহলে চিন্তায় কাটবে। সব কাজেই লেট করে ফেলেছি। রক্তের ব্যবস্থাটা আরো আগে করে রাখার দরকার ছিলো। নিজের উপর নিজেরই রাগ লাগছে। চা খেতে আর ইচ্ছে করলো না। শহীদ মিনারে নিজের প্রাইভেট টিউশনি নিয়ে গল্প করে মানুষকে উৎসাহ দেওয়ার কাজ ওই ভদ্রলোক আজও করছেন। আমার এখন মনে হয়, লোকটার পেশা মূলত টিউশনি না। এটা ওনার গল্পের টপিক। উনি আসলে একজন গল্পকার। গল্পকাররা খুব সাজিয়ে গুছিয়ে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলতে পারে। তাদের গল্পের ধরণ বাস্তবতার সাথে মিলে যায়। সেজন্য গল্পকারদের কথা মানুষ খুব কাছ থেকে আগ্রহ নিয়ে শুনে। নিজের জীবনের সাথে মিলে গেলে বাহবা দেয়। আবার মতাদর্শের পার্থক্য হলে সমালোচনা করে। তবুও গল্পকারদের স্বাধীনতা থাকে। গল্প বলবার স্বাধীনতা!
হাসপাতালে চলে এসেছি সোজা চিত্রার ওয়ার্ডের সামনে। চায়ের দোকানের ছেলেটা আমাকে আসতে দেখে নি। নিশ্চয় অপেক্ষা করেছে। আমি যাই নি। কিছুটা মন খারাপ হয়েছে। কিন্তু সম্পর্ক থেমে যায় নি। মায়ার সম্পর্ক থামে না। না পাওয়াতে ভালোবাসা কমে না। কিছু সম্পর্ক টিকেই থাকে দূরত্বে, পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় না পাওয়াতে!
মধ্যরাত তাই মানুষজন তেমন গল্প গুজব করছে না। যারা ঘুমানোর সুযোগ পায় নি, তারাই বসে আছে। কেউ বসেই দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখছে। আমার তেমন ঘুম আসছে না। দেয়ালে হেলান দিলে আরো বেশি খারাপ লাগে। চিত্রাও হয়তো ঘুমাবে না। গভীর দুঃখ আর গভীর আনন্দ; এই দুটো জিনিস মানুষকে ঘুমোতে দেয় না। গভীর আনন্দের খুব নিকটে আমি আর চিত্রা। আমাদের আরো একজন কাছের মানুষ হবে। আলো দিবে চিত্রার আমার সাজানো ছোট্ট সংসারে!
বছর পেরিয়ে তখন আবার শীতকাল। শহরে শীতটা সকাল বেলাতেই বেশি থাকে। চিত্রাকে তাই খুব সকালে উঠতে দেই না। আমি নিজেই উঠে চা বানাই। একটু রোদ উঠলে চিত্রাকে উঠিয়ে বেলকুনিতে নিয়ে যাই। বেলকুনির একপাশ দিয়ে এক চিলতে রোদ ঢুকে। চিত্রার মুখে কখনো সেই রোদ এসে পরে। এখন আর আগের মতো পিচ্চি দেখতে লাগে না। একটু পরিপক্কতা এসেছে চেহারায়। স্বভাব তবুও বাচ্চাদের মতো। আমি নিজের হাতে চায়ে টোস্ট ভিজিয়ে খাইয়ে দেই। চিত্রা বেলকুনিতেই বসে থাকে। আমি ক্যাম্পাসে যাই। চিত্রা স্কুলে যায় না। গর্ভকালীন ছুটি পেয়েছে ছয় মাস। বাসায় ফিরি বিকেলে। এই সময়টা চিত্রা রান্না করে। বাসায় ফিরলে দুজন একসাথে খাই। সন্ধ্যার আগে চিত্রাকে হাটতে নিয়ে যাই ছাদে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে সামান্য কষ্ট হয়। তাই একবারই উঠা হয় দিনে। লম্বা সময় ছাদে কাটাই দুজনে। রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াই। কিছুটা শীত লাগে সন্ধে নামার আগে। চিত্রার গায়ে চাদর জড়িয়ে দিতে গেলে বলে,
‛তোমার শীত লাগছে না?’
‛তেমন বেশি না। তুমি চাদরটা নাও। বেবিটার শীত লাগবে তো।’
‛এই শুনো না, শীত আমারও লাগছে খুব।’
‛হ্যাঁ, তো চাদরটা নাও না?’
‛না চাদর না।’
‛কি তাহলে?’
চিত্রা অনেকক্ষন তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টিতে। বলে,
‛জড়িয়ে ধরো না।’
কতো মানুষজন আশেপাশের ছাদে। তবুও চিত্রার এই ছোট্ট আবদারে আমি বোকা হয়ে যাই। বলি,
‛জড়িয়ে ধরলে শীত কমবে?’
‛হুম, দেখো তো। একটুও শীত থাকবে না।’
‛আসো।’
চিত্রার একপাশ চাদর দিয়ে ঢেকে দেই। তারপর আলতোভাবে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখে দেই। চিত্রা আমার বুক থেকে মাথা উঠায় না। বলে,
‛বেবিটা আমাদের প্রেম দেখছে তাই না?’
‛শুধু বেবিটা না, আশেপাশের সব মানুষ দেখছে।’
‛মানুষজন নামছে না কেনো বলো তো? সন্ধ্যা তো হলো।’
‛যতক্ষণ আমরা এভাবে জড়িয়ে থাকবো, ততক্ষণ কেউ নামবে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে কি করি।’
চিত্রা হটাৎ নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। বলে,
‛দূর সবাই কেমন তাকিয়ে আছে। চলো নীচে।’
নিচে নামতে অনেক সময় লাগে। চিত্রার শরীর অনেকটা ভারী হয়েছে। ধীরে ধীরে নামে। আমি হাতটা ধরে রাখি। নিচে নেমে নিজেই চা বানিয়ে বেলকুনিতে আসে। দুজনে গায়ে চাদর জড়িয়ে পাশাপাশি বসি। চা ঠান্ডা হয়ে যায়, খেয়াল থাকে না। চিত্রা বলে,
‛এই নাম রাখবা না বেবির?’
‛আগে তো দেখি কি বেবি হয়।’
‛আরে ছেলে বেবিই তো হবে। আমি জানি।’
‛আমি জানি তোমার মতো দেখতে মেয়ে বেবি হবে।’
চিত্রা ক্ষেপে যায়। বলে,
‛মেয়ে বেবি অনেক শান্ত হয়। আমার বেবিটা দুষ্ট বেশি, নড়াচড়া করে। ছেলেই হবে দেইখো।’
‛আচ্ছা টেস্ট করে দেখি?’
‛কিভাবে?’
‛হাসপাতালে যাই চলো কাল।’
হাসপাতালে যাবো বলতেই চিত্রার মুখটা কেমন চুপসে যায়। ছোট্ট ইনকাম আমাদের। সঞ্চয় নেই। বলে,
‛থাকুক না মিহির। ছেলে নাহয় মেয়ে একটা তো হবেই। হলেই দেখবো নে।’
‛বেশি কথা বলবা না তো। বেবির নাম ঠিক করতে হবে না?’
চায়ের কাপ টেবিলে রেখে চিত্রা আমার হাত ধরে। বলে,
‛ঠিক আছে, কাল যাবো হাসপাতালে।’
পরদিন যাই হাসপাতালে। আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টে আসে ছেলে বেবি হবে। রিপোর্টটা দেখানোর সময় চিত্রা ছিলো না ডাক্তারের সামনে। একটু সমস্যা আছে। বেবির পজিশন একটু নীচে। সমস্যা তেমন জোরালো না। অস্ত্রোপচার করে ডেলিভারি করাতে হবে, এই। চিত্রাকে তখন বলি নি কথাটা। বাসায় এসে চিত্রা ব্যাস্ত ছেলের নাম ঠিক করতে। আমি একটা নামও ঠিক করি নি। সম্পূর্ণ দায়িত্ব চিত্রার হাতে। মুসলিম রীতিতে আর হিন্দু রীতিতে নামের ধরণ আলাদা হয়। আমার তাতে আপত্তি নেই। চিত্রা ছেলের নাম ঠিক করে টোটন। আমি সকালে ডাক দেই ঘুম থেকে উঠতে।
‛এই টোটনের মা, উঠো না। বেলা তো অনেক হলো।’
বিছানায় বসে দুহাতে বাচ্চাদের ভঙ্গিতে চোখ ডলতে ডলতে বলে,
‛মা হয়ে গেলাম তাইনা মিহির?’
‛হও নাই, হওয়ার পথে আছো। আগে থেকে রিহার্সেল করতেছি।’
‛এই না। তুমি আমাকে চিত্রাই ডাকবা। টোটনের মা বলে তো বাইরের মানুষ ডাকবে। তুমি আলাদা, স্পেশাল। সবাই যা ডাকবে, তুমি তা ডেকো না তো।’
‛ঠিকআছে, মাই ডেয়ার চিত্রা। উঠো এবার চা ঠান্ডা হয়।’
চা দিয়ে টোস্ট ভিজিয়ে ভিজিয়ে আমি চিত্রার মুখে দেই। চাইলে ও নিজের হাতেই খেতে পারে। কিন্তু খাবে না। এই এক বাচ্চামি স্বভাব ওর। বেলা বাড়ে। এক চিলতে রোদ কখন পুরো বেলকুনিতে ছেয়ে যায়, খেয়াল থাকে না। মাঝে মাঝে চিত্রাকে বাসায় রেখে বেরোতে ইচ্ছে হয় না। তবুও বেরোতে হয়, রোজ একই নিয়মে!
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন