সঙ্গোপনে ৯

অপারেশন থিয়েটারের সামনে লাল বাতি। ভেতরে চিত্রার ডেলিভারি অস্ত্রোপচার চলছে। কিছুক্ষন আগেও একজন ডাক্তারকে ছুটোছুটি করে ভেতরে ঢুকতে দেখেছি। আমার এখানে অবস্থান নিষেধ। তবুও মন মানছে না। ব্লাড ব্যাংক থেকে আসতে আসতে এইটুকু সময়ের মধ্যে চিত্রাকে ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলেছে। রক্তের ব্যাগ দুটো ভেতরে দিয়ে নার্স যখন বের হলো, আমি পথ আটকে ধরেছিলাম। বললাম,
‛আমার চিত্রা?’
নার্সের চোখে চিন্তার ছাপ ছিলো। বললো,
‛কন্ডিশন সিরিয়াস। এখনি অস্ত্রোপচার হবে।’
আমি সামনের লাল বাতিটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। নার্স বলে গেলো,
‛আপনি একটু ওয়ার্ডে গিয়ে দাঁড়ান, নয়তো বাইরে দাঁড়ান। দরকারে ডাক দেবো। এখানে থাকলে ঢুকতে বেরোতে সমস্যা।’
নার্সের কথাগুলো কানে নেই নি। আমি তবুও দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি জানি, অপারেশন থিয়েটারে ঢুকার আগে চিত্রা আমাকে খুঁজেছে। কিছু বলতে চেয়েছে। আমার হাতটা শক্ত করে ধরতে চেয়েছে। চিত্রার কি এখন জ্ঞান আছে? জ্ঞান থাকলে নিশ্চয় আমাকে খুঁজবে। ও ভয় পায়। খুব বেশি ভয় পায়। এজন্য আমাকে সবসময় কাছে চায়। আমি যেতে চাই। সামনের এই কাঁচের দরজাটা ভেঙে হলেও চিত্রার কাছে যেতে চাই। বলতে চাই; চিত্রা তোমার মিহির আছে, আর কোনো ভয় নেই।

সামনের দরজাটা খুলে গেলো। নিজের হৃদপিন্ডের প্রতিটা স্পন্দন শুনতে পাচ্ছি। একজন নার্স দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট একটি নবজাতক কোলে নিয়ে। এই নবজাতকের শরীরে আমার রক্ত আছে। আমার অস্তিত্ব আছে ওর মগজে। এই মাত্র পৃথিবীর আলো দেখতে পাওয়া এই নবজাতকের বাবা আমি! এটাই কি সেই মুহূর্ত! বাবা হওয়ার মতো আনন্দময় মুহূর্ত! পৃথিবী আমায় বাবা হিসেবে মেনে নিবে? আমি জানি না!

শিশুর মুখে কান্না। আমি হাত পাতলাম। একটা সাধারণ তোয়ালে দিয়ে পেঁচানো শিশুটি আমার কোলে দিয়ে নার্স বললো,
‛ছেলে হয়েছে।’
ছোট্ট এই শিশুটির চেহারা চিত্রার মতোই। যার কাছে আজও জমে আছে, বাকি থাকা আমার অর্ধেক প্রেম! আমি কপালে আলতো করে একটা চুমো দিয়ে বললাম,
‛এ আমাদের টোটন।’

টোটনের জন্ম হয়েছে। পুরো পৃথিবী আলোকিত হওয়ার দিন আজ। সবার মুখে হাসি থাকবে। সমস্ত মাছেরা সমুদ্রের তীরে এসে পৌঁছাবে। সমস্ত পাখিরা গান ধরবে। মৃদু বাতাসে গাছের পাতায় ঝিরঝির শব্দ হবে। সমস্ত দুঃখ মুছে যাবে পৃথিবী থেকে। এমন আনন্দ নিয়েই টোটন একশো বছর বাঁচবে এই পৃথিবীতে!

আমার এতো আনন্দের দিনে চোখে হতাশার ছাপ নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন নার্স। বললাম,
‛চিত্রা কেমন আছে?’
নার্স কিছুই বললো না। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে আমার চোখে। খোলা দরজায় আমি ভেতরে তাকালাম। ভেতরে ছুটোছুটি চলছে এখনো। আমি কিছু বুঝতে পারি না কি করবো। আমি শুনতে পাচ্ছি শুধু আমার কোলে একটা শিশুর কান্না! অপারেশন থিয়েটারের ভেতরে দৌড় দিলাম। একজন ডাক্তার এসে দরজা আটকালো। বললো,
‛একটু অপেক্ষা করেন, স্যার আসছে।’
ডাক্তার মুখ থেকে মাস্ক খুলে ফেললো। মুখে ঘাম আমি দেখতে পাচ্ছি। আরেকজন ডাক্তার আসলো ভেতর থেকে। বললো,
‛অবস্থা ভালো না। অবস্ট্রেটিকাল হেমারেজ। এখনি কিছু করতে হবে।’
চিকিৎসার ভাষা আমি বুঝি না। আমি আমার চিত্রাকে শুধু চাই। ডাক্তারকে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে চাইলাম। তিন চারজন পেছন থেকে ধরলো আমাকে। আমার কোলে টোটনের কান্না ঢাকা পড়ে গেছে আমার চিৎকারে। পৃথিবীর সমস্ত মানুষেরা হয়তো শুনছে আমি ডাকছি আমার চিত্রাকে। বাতাসে একটি শব্দই ভেসে বেড়াচ্ছে শুধু; ‛চিত্রা?’

ডাক্তাররা টেনে বের করলো আমাকে। বললো,
‛পাগলামি করবেন না প্লিজ। পেশেন্টের রক্ত লাগবে আরো।’
এক হাতে টোটনকে ধরে অন্য হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। বললাম,
‛কতো রক্ত লাগবে? আমার সব নিয়ে নেন। গ্রূপ এক।’
ডাক্তার কি যেনো বলতে নিলো, ততক্ষণে অন্য একজন ডাক্তার ভেতর থেকে ছুটে আসলো। বললো,
‛এখনি ভেন্টিলেটর সাপোর্টে নিতে হবে।’
আমি সশব্দে চেঁচিয়ে উঠলাম,
‛তাহলে নিচ্ছেন না কোনো ভেন্টিলেটর সাপোর্টে? ডাক্তারকে ঠেলে আবার ভেতরে ঢুকতে চাইলাম। চিত্রাকে একবার দেখতে চাই। টোটনকে দেখে চিত্রা খুশি হবে। বুকে জড়িয়ে আদর করতে চাইবে। আমি ডাকি,
‛চিত্রা?’
আবার আটকে দিলো আমাকে। বললো,
‛এখন পাগলামি করার সময় না। আপনি দাঁড়ান এখানে।’
ওয়ার্ড থেকে আসলো একজন ডাক্তার। বললো,
‛হাসপাতালের আইসিইউ খালি নেই। সব মুমূর্ষু রোগী ভর্তি। বাইরে ব্যবস্থা করতে হবে।’
ভেতর থেকে একজন চেঁচিয়ে বললো,
‛কন্ডিশন ভালো না। এখনি আইসিইউ তে নিতে হবে।’
আমি কি করবো বুঝতে পারছি না।
‛আপনি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করেন। পিজিতে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।’ কথাটা বলেই ভেতরে চলে গেলো ডাক্তার।  মুহূর্তের মধ্যে বাকি ডাক্তার নার্স সবাই অপারেশন থিয়েটারের ভেতরে চলে গেলো। আমি বাইরে একা। টোটন চিৎকার করছে। কার কোলে দিবো টোটনকে? কেউ নেই। অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ইমারজেন্সি গেটে যেতে হবে। টোটনকে কোলে করেই দৌড় দেই। একটু যেতেই তিনজন আনসার সদস্য পিছু পিছু দৌড়ে আসে। যেনো চোর ধরতে দৌড়াচ্ছে তারা। আরো কয়েকজন মিলে জটলার মতো হয়ে গেছে। আমি ভিড়ের মধ্যে আটকে গেছি। টোটনের চিৎকার থামছে না। একজন আনসার সদস্য আমার শার্টের কলারে ধরলো। বললো,
‛শালা চোর। কার বাচ্চা নিয়া পালাইতাছস?’
আমার অবাক হবারই কথা। কিন্তু অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার সময় নেই। আনসার সদস্যকে ধাক্কা দিলাম। বললাম,
‛পথ ছাড়েন। বাচ্চা আমার এটা।’
আনসার সদস্যকে ধাক্কা দেওয়াতে বাকিরা ক্ষেপে গেছে। পথ আরো বেশি করে আটকালো। আশেপাশের মানুষ জনের মধ্যে দু তিনজন অতি উৎসাহে চোর চোর বলে চিৎকার করতে থাকে। আশেপাশে আরো মানুষ জমতে থাকে। আমার এর থেকে বের হবার পথ নেই। পেছন থেকে কে যেনো লাথি মারলো একটা। একজন মারতে বাকিরা থেমে নেই। আমি কোনোরকম কুঁজো হয়ে টোটনকে আগলে রাখি। আশেপাশের ওয়ার্ড থেকে ডাক্তার নার্স বেরিয়ে আসে। আমি কিছু বলতে পারি না। শরীরের কিছু কিছু জায়গা জখম হয়ে গেছে। ঘটনার সামাল দিতে একজন ডাক্তার এগিয়ে আসলো। বললো,
‛বাচ্চা কার?’
আমি যেনো কথা বলবার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। মাথা উঁচু করে অনুভব করলাম, নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। কে যেনো মুখে ঘুষি দিয়েছে। কোনোরকম জবাব দিলাম,
‛বাচ্চা আমার স্যার। পেশেন্টের অবস্থা ভালো না। অ্যাম্বুলেন্স আনতে যাচ্ছিলাম।’
একজন আনসার পেছন থেকে বলে উঠলো,
‛শালায় একটা চোর স্যার। ছাড়বেন না। ওয়ার্ড থেকে বাচ্চা নিয়ে দৌড় দিছে।’
ডাক্তার ধমকে উঠলো। বললো,
‛চোর না কি, সেটা আমি দেখতেছি। আপনি থামেন।’
ডাক্তার সামনে থেকে সবাইকে সরিয়ে দিলো। আমার কাধে একটা হাত রাখলো। বললো,
‛বাচ্চাটা কারো কাছে দিয়ে আসবেন না?’
‛কার কাছে দিয়ে আসবো। কেউ নাই স্যার।’
আমার কথার সাথে চোখ দিয়ে পানি এসে পড়ে। ডাক্তার সহমর্মিতার চোখে তাকালো। বললো,
‛হাসপাতালে বাচ্চা চুরি হয় এভাবে। উনারা বুঝতে পারেনি আসলে। আপনার সাথে যেটা হইছে, সরি। আপনি যান।’
ডাক্তারের চোখে একপলক তাকিয়ে মনে হলো, ধন্যবাদ জানানোর সময় নেই। অ্যাম্বুলেন্স লাগবে। আবার দৌড় দেই গেটের দিকে। সারি সারি অ্যাম্বুলেন্স রাখা আছে। ড্রাইবারদের সাথে দালালদের ঘোরাফেরা। দালালরা দরদাম ঠিক করে। গিয়েই জোরে বললাম,
‛আমার একটা অ্যাম্বুলেন্স লাগবে।’
কয়েকজন আসলো সামনে।
‛কই যাইবেন ভাই? পেশেন্ট নাকি ডেডবডি?’
একটার পর একটা প্রশ্ন আসতে থাকে। আমি বললাম,
‛অক্সিজেন সাপোর্ট সহ একটা গাড়ি দেন ভাই। পিজিতে যাবো।’
পিজিতে যাবো শুনে অনেকেই পিছিয়ে গেলো। একজন বললো,
‛পিজিতে আবার অ্যাম্বুলেন্স লাগে নাকি। একটা সিএনজি নিয়া চইলা যান।’
হাতে চাবি দেখে ড্রাইবার মনে হওয়া একজনের সামনে গিয়ে বললাম,
‛ভাই আমার বিপদ। একটু আসেন প্লিজ।’
ভাড়ার কথা কিছুই জিজ্ঞেস করলো না লোকটা। বললো,
‛পেশেন্ট কই?’
‛অপারেশন থিয়েটারে আছে। বেবি কেয়ার ইউনিটে আসেন অক্সিজেন সিলিন্ডার সহ ট্রলি নিয়ে।’ বলেই আবার দৌড় দিলাম হাসপাতালের ভেতরে।

ব্যথা অনুভব হচ্ছে না, কিন্তু নাক মুখ বেয়ে রক্ত পড়ছে টের পাচ্ছি। শার্টটা পেছনের দিকে অনেকটুকু ছিঁড়ে গেছে। কে যেনো টান মারছে জোরে। টোটনকে জড়িয়ে রাখা নীল তোয়ালেটাতে কয়েক ফোঁটা রক্ত পড়েছে। জন্মের পর থেকে একনাগাড়ে চিৎকার করে যাচ্ছে টোটন। চিৎকার শুনে আশেপাশের ওয়ার্ড থেকে মানুষ তাকায় বাইরে। অবাক হয় হয়তো। উস্কোখুস্ক চুলের রক্তাক্ত একজন মানুষ চিৎকার ফেরি করে দৌড়াচ্ছে!

অপারেশন থিয়েটারের সামনে গিয়ে থামতেই নীরবতা। ডাক্তার নার্সদের কোনো ছুটোছুটি নেই। যে যার মতো করে দাঁড়িয়ে। কেউ কিছু বলছে না। আমার কোলে শুধু টোটনের কান্না। টোটনের কি তার মায়ের বুক থেকে শালদুধটুকু পেলো না?

দরজায় আর কেউ আমাকে আটকালো না। এইতো একটু সামনে চিত্রা। আমার চিত্রা। আমি দেখতে পাচ্ছি চিত্রাকে। বেডে শুয়ে আছে। দৌড়ে যাই।
‛চিত্রা?’
‛চিত্রা তাকাও আমার দিকে?’
‛চিত্রা?’
চিত্রা চোখ খুলে না। জলপ্রপাতের মতো দেখতে লাগে এক জোড়া চোখ; আর দেখতে পাই না!




মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

এখনো ভালোবাসি তোমায়

বলতে পারিনি "ভালোবাসি"!

একটি প্রত্যাখানের গল্প: "তবুও ভালোবাসি"