অয়না

 এক

শিমু বেশি সুন্দর নাকি শিমুল ফুল? অদ্ভুত একটা প্রশ্ন নিয়ে খেলছে নিয়ন। ছোটদের খেলাগুলো বোধয় এরকম অদ্ভুতই হয়। উত্তর খুঁজতে হাত বাড়িয়ে একটা শিমুল ফুল ধরতে চাইলো। হাতে আলতো স্পর্শ লেগে ফুলটি নদীতে পড়ে গেলো। এই নিয়ে চারবার এমন হলো। পেছন থেকে আবার ডাকলো শিমু;

‛নিয়ন আয় না, চল বাড়ি যাই?’

নিয়ন পেছন ফিরে মাথা জাঁকালো। প্রায় আধঘন্টা যাবৎ এভাবেই শিমুর কথায় নিঃশব্দে উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। শিমু তবুও একা বাড়ি যাচ্ছে না। এক হাতে জামা উঁচু করে ধরে অন্য হাতে জুতোজোড়া নিয়ে হাঁটু জল পেরিয়ে সামনে এগুতে এগুতে বললো,

‛মা আমাকেও বকবে রে। বলে আসি নি।’

নিয়ন আবার পেছনে ফিরলো। জোয়ারের পানিতে বøকগুলো তলিয়ে গেছে। গভীরতা পরিমাপ করা কষ্টকর। শিমুকে আসতে দেখে চেঁচিয়ে উঠলো,

‛আর আসিসনে শিমু। পানি বেশি। তলিয়ে যাবি।’

বলতে বলতে পাশ দিয়ে যাওয়া বড় এক লঞ্চের ঢেউ আছড়ে পড়লো শিমুল তলায়। শিমু মুহূর্তেই বøকের মধ্যে পড়ে গিয়ে পানিতে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। নিয়ন দৌড় মারলো। তাতে বেশ লাভ হলো না। দুজনেরই তলিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো। পানি খুব বেশি না। কোমর অব্দি হবে। কিন্তু একের পর এক ঢেউ আছড়ে পড়ায় দুজনের কেউই উঠে দাঁড়াতে পারলো না। কোনোমতে নিয়ন শিমুর হাতটা ধরে রাখলো। ঢেউ কমতেই শিমুর অবস্থা খারাপ। পানি খেয়েছে বেশ কিছু। চোখদুটো লাল হয়ে গেছে। নিয়ন উঠে দাঁড়িয়ে শিমুর হাতটা ছেড়ে দিলো। নদী থেকে কুঁড়িয়ে একটা শিমুল ফুল হাতে নিলো। শিমুল ফুলের রং টকটকে লাল। শিমুর গায়ের রং শিমুল ফুলের মতো নয়। হবারও কথা নয়। মানুষের গায়ের রং কখনো লাল হয় না। তবুও শিমুল ফুলের সঙ্গে কেনো শিমুর তুলনা? নিয়ন ফুলটা শিমুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

‛নে লিপিস্টিক আছে এর ভেতর। ঠোঁটে দিস।’

শিমু কথা বলতে পারলো না। ভয়ে কাঁপছে এখনো। ফুলটা ফেলে দিয়ে নিয়নের হাতটা আবার ধরতে চাইলে নিয়ন হাত ছাড়িয়ে নিলো। বললো,

‛বললাম আসিসনে, তাও কেন আসতে গেলি? এখন ভালো হইছে। যা বাড়ি গিয়ে কাকির হাতে মাইর খা।’

শিমু আবার জোর করে নিয়নের হাতটা ধরে বললো,

‘তুই ও আয় না? আমি চাল আর আলু লুকিয়ে রেখেছি। মা দেখে নি। অয়নাদের বাড়িতে আজ খিচুড়ি রান্না হবে। তোকে আর আমাকেও নিয়েছে খেলায়। চল যাই।’

শিমুর জোরাজোরিতে নিয়ন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। নরম গলায় বললো,

‛না রে। কাকি তো বলেছেই আর বাড়ি না যেতে। এখন গেলে দেখিস, আবার বকবে। বলবে চলে যেতে।’

‛এখন গিয়ে অয়নাদের বাড়িতেই থাকিস। রাতে মা ঘুমোলে আমি লুকিয়ে দরজা খুলে দিবো নে। মায়ের মন ভালো হলে সকালে আর বকবে না দেখিস।’

শিমুর যুক্তিও খারাপ না। এখানে তো অন্তত রাত পার করা সম্ভব না। সন্ধা পেরোতেই নদীর পাড় শান্ত হয়ে পরবে। জনমানবশুন্য শিমুলতলায় তখন কুকুররা আস্তানা গড়বে। কুকুরে নিয়নের ভীষন ভয়। কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললো,

‘যাবো, কিন্তু অয়নাদের বাড়িতে তো রোদ নেই। ভেজা কাপড় শুকাবে না। তুই তাহলে যা। আমি কাপড় শুকিয়ে চলে আসছি।’

‘আয় তাহলে, সন্ধের আগে আসিস। সন্ধে বেলা মা ঘাটে থাকবে, দেখে ফেলে না যেনো।’

‘দেখবে না, তুই যা।’

শিমু হাটা ধরলো বাড়ির পথে। সদ্য বড় হয়ে ঘাড় পর্যন্ত নেমে আসা চুল বেয়ে পানি পড়ছে শরীরে। এ দৃশ্য অসম্ভব সুন্দর। চুলগুলো শুকনো থাকলে হালকা বাতাসে উড়তে চাইতো। উড়ো চুল আর ভেজা চুলে মেয়েদের সৌন্দর্য এক না। শিমুল ফুল আসলে শিমুর চাইতে বেশি সুন্দর না। বসন্ত চলে গেলে শিমুল ফুল ফুরিয়ে যাবে, শিমুর সৌন্দর্য ফুরোবে না। নিয়ন অনেকক্ষন তাকিয়ে থাকলো শিমুর চলে যাওয়াতে। হটাৎ কি ভেবে দু'হাত প্রসারিত করলো আকাশের পানে। লঞ্চে যাতায়াত করা দূরের যাত্রীরা তাকিয়ে থাকে নিয়নের দিকে। কাকতাড়ুয়া সেজে কে দাঁড়িয়ে আছে নন্দিত এই গ্রামের পথে? লোকে ভাবে; এ হয়তো কোনো খেলা, আসলে তা না। বিকেলের নরম হয়ে যাওয়া রোদ এসে নিয়নের গায়ে পড়ছে। নিয়ন দু’হাত প্রসারিত করে রেখেছে গায়ের জামা শুকাতে। বিকেলের রোদ ফুরোতেই শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে। কাকতাড়ুয়ার বেশ ছেড়ে অর্ধভেজা জামাতে নিয়ন হেঁটে চললো বাড়ির পথে। এইতো, জীবন কতো সুন্দর; পেরিয়ে যাচ্ছে বয়ে চলা সগ্রামের বাঁকে বাঁকে!

বাড়ির পেছনের ঝোপ-জঙ্গল পেরিয়ে অয়নাদের বাড়িতে গিয়ে উঠলো নিয়ন। সামনে দিয়ে আসলে কাকি দেখে ফেলতো এই ভয়ে পেছনের পুকুর পাড় পেরিয়ে আসা। কিন্তু এসে দেখলো অয়নাদের উঠোন ফাঁকা। অন্যদিন চড়ুইপাতি খেলা থাকলে অনেকে থাকে উঠোনে। বাইরে মাটি দিয়ে বানানো আগলা চুলোয় রান্না হয়। শিমুও নেই। নিয়নের মন খারাপ হলো। ঘরের জানালা দিয়ে অয়নাকে ডাক দিলো। অয়না আসতেই নিয়ন সামনে গিয়ে জানালার দিকে ঝুঁকে বললো,

‛শিমু তোমাদের বাড়ি আসেনি অয়না?

অয়না মন খারাপ করে বললো,

‘না তো। আসবে বলে গিয়েছিলো। কিন্তু আসলো না যে?’

‘আমি তো জানিনে। শিমুলতলায় ছিলাম। আমাকেও বলে এসেছিলো আসবে তোমাদের বাড়ি।’

‘আসলো না তো। আচ্ছা তুমি থাকো না? মা রাতে খিচুরি রাঁধবে বলেছে।’

‛না থাক, আজ যাই। কাল আবার আসবো নে শিমুকে নিয়ে।’

অয়না ঝং ধরে যাওয়া জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। নিয়ন যখন মুখ ফেরাতে যাবে, তখনই ফাল্গুনী ধমকা হওয়ায় অয়নার চুল উড়তে লাগলো। নিয়নের হটাৎ মনে হলো; ভেজা চুলের চাইতে উড়ো চুলেই মেয়েদের বেশি সুন্দর লাগে! চোখ ফিরিয়ে নিয়ন হাঁটা ধরলো পুকুর ঘাটের উদ্দেশ্যে। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। ভাবলো, কাকি এতক্ষণ পর্যন্ত থাকবে না ঘাটে। ঘাটের ঠিক পাশে একটা লিচু গাছ আছে। গাছের মগডালে কয়েক থোকা লিচু পেকে লাল হয়ে আছে। অন্ধকারে গাছের মগডালে চড়তে গিয়ে নিয়নের পা কাঁপতে লাগলো। লিচুর থোকায় টান মারতেই মড়মড় শব্দে ডাল ভেঙে পানিতে পড়ার ধপাস এক শব্দ।

সালাম শেখ ‛কে কে’ বলে চেঁচিয়ে উঠলো। নিয়ন লিচুর থোকা সহ ঘাট বেয়ে উপরে উঠতেই সালাম শেখের টর্চের আলো নিয়নের মুখে এসে পড়লো। নিয়নকে দেখেই দৌড়ে আসলো সালাম শেখ। 

‛নিয়ন, বাপ আমার! তোরে খুঁইজা খুঁইজা সারা বিকাল হয়রান। শিমু কইলো শিমুল তলায়, যাইয়া দেখি নাই। বাড়ি যাছ নাই কেন বাপ? কই আছিলি সারা বিকাল?’

নিয়ন লিচুর থোকা হাতে নিয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো। সালাম শেখ আরেকটু কাছে গিয়ে নিয়নের ভেজা চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,

‛কি হইছে বাপ তোর?’

নিয়ন অন্ধকারেই সালাম শেখের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,

‛তুমি আমারে বাপ ডাকো কেন কাকা? কাকি তো কয় আমি অনাথ। আমার কেউ নাই। কও কাকা, অনাথ মানুষের আবার বাপ থাকে?’

সালাম শেখ এক ঝাঁকিতে নিয়নকে কোলে নিয়ে ফেললো। বললো,

‛তুই এইটা কি কলি বাপ? তোরে ছাড়া আর কারে বাপ ডাকুম আমি? তুইও আমারে দুঃখ দিলি বাপ?’

নিয়ন সালাম শেখের কাঁধে নাক ঘষতে ঘষতে বললো,

‛নামায়া দাও কাকা। কোলে চড়তে দেখলে কাকি আবার বকবো।’

সালাম শেখ নিয়নকে আরো শক্ত করে ধরে বললো,

‛বকলে বকুক, অনেকদিন পর আমার বাপটারে আজকে কোলে নিলাম।’

নিয়ন আর কিছু বললো না। সালাম শেখের গলা জড়িয়ে রাখলো। আগে রোজ এভাবে কোলে চড়া হতো। সালাম শেখ নিয়নকে কোলে নিয়ে সকালে বিলে বের হতো ক্ষেত দেখতে। বলতো, ‛এই সবগুলো ক্ষেতের অর্ধেক তোর। বড় হইলে ফসল বুনবি।’ নিয়ন কিছু না বুঝেই হ্যাঁ বোধক মাথা নারতো। সহজে কোল ছাড়তে চাইতো না। সালাম শেখ নিয়নকে কাঁধের সাথে গামছা দিয়ে বেঁধে ক্ষেতে ধান লাগাতো। ক্ষেতের আইল দিয়ে যাওয়ার পথে লাজলু মিয়া একবার জিজ্ঞেস করেছিলো,

‛কারে এমনে পিঠের সাথে বাইন্দা রাখছো সালাম ভাই?’

সালাম শেখ মুখে হাসি ফুটিয়ে বলেছিলো, ‛এইটা আমার বাপ। বাপরে ছাড়া থাকতে পারি না মিয়া, তাই বাইন্দা রাখি শরীরের লগে সবসময়।’

লাজলু মিয়া পান চিবোতে চিবোতে বলে গেলো,

‛দেইখো সালাম ভাই, তোমার এই বাপ যেমন আবার তোমারে কোনোদিন না ছাড়ে। বড় তো করতাছো খুব শখ কইরা।’

সালাম শেখ লাজলু মিয়ার কথায় জবাব না দিয়ে নিয়নকে জিজ্ঞেস করলো,

‛যাবি রে বাপ, কোনোদিন আমারে ছাইড়া?’

নিয়ন কিছু না বুঝেই সেদিন উত্তর দিয়েছিলো, ‛না।‘

এতোদিন পর কোলে উঠে সেদিনের কথাটা নিয়নের খুব মনে পড়তে লাগলো। সালাম শেখ বাড়ির আঙিনায় পা রাখতেই নিয়ন আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,

‛কাকি যতই বকুক, আমি আর কোনোদিনও তোমারে ছাড়া যাইতে চামু না কাকা।’

সালাম শেখ হালকা নুয়ে গিয়ে নিয়নের কপালে চুমু এঁকে দিলেন। মাথা উঠাতেই পারু বিবির গলার আওয়াজ,

“এমন আদর পাইতে পাইতেই তো ঘরে এহন জমিদারগিরি দেখায়। পরের ঘরে খায়, আবার কিছু কইলেই আবার ছেদ কতো, ‛থাকুম না তোমাদের ঘরে।’ তয় যা? আইলি কেন আবার?”

নিয়ন কিছু বললো না। সালাম শেখ গর্জে উঠলো,

‛একটা বাচ্চা মানুষের সাথে কেমনে কথা কইতে হয়, শিখো নাই পারু?’

‛বাচ্চা অয়? আস্ত একটা জমিদার। পায়ের উপর পা তুইলা খাইতে চায়।’

শিমু ঘর থেকে বেরিয়ে বলে উঠলো,

‛নিয়নরে দিয়া তো সারাদিন কম কাম করাও না মা। জমিদাররা কাম করে?’

‛সবার দেহি দরদ ফাইট্টা পরে। থাক তোরা আদরের জমিদার লইয়া। আমিই থাকুম না এই বাড়ি। পরের পোলাইপাইন পালনের এতো শখ নাই আমার।’

পারু বিবি ভেতরের ঘরে গিয়ে সজোরে দরজা লাগিয়ে দিলো।

সালাম শেখ শিমুকে ডাক দিয়ে বললো,

‛দেখ তো মা ভাত আছে নাকি? পোলাটা সারাদিন কিছু মুখে দেয় নাই।’

শিমু রান্নাঘর থেকে বললো,

‛ভাত আছে আব্বা, তরকারি নাই।’

‛ডিম থাকলে একটা ডিম আর পেঁয়াজ মরিচ দে মা, আমি একটু বাজি কইরা দেই।’

‛ডিম আছে আব্বা, আনতেছি।’

শিমু পেঁয়াজ মরিচ আর বটি নিয়ে বেরিয়ে দেখলো, 







মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

এখনো ভালোবাসি তোমায়

বলতে পারিনি "ভালোবাসি"!

একটি প্রত্যাখানের গল্প: "তবুও ভালোবাসি"