শিমুল ১

জন্ম থেকে প্রায় আট বছর পার হয়েছে নিয়নের সাথে জীবনের। আর নিয়ন? মাত্র তো চার মাস আগে পৃথিবীতে এসে থেকেছে একা। তার মধ্যে হাটতে শেখা, কথা বলতে শেখা, তারপর না শুরু হয়েছে সম্পর্কে বেঁধে রাখতে শেখা। তার মানে এইতো কিছুদিন একসাথে থাকা। মাত্র আট বছর বয়সে কতটুকুই বা পথচলা। তবুও কতো সুন্দর গেঁথে গেছে জীবনের সাথে জীবন, একজনকে ছাড়া অন্যজন কতো একা! মানুষটার জন্য বুকের ভেতর কতো কতো মায়া! কিন্তু এখন কোনো মায়া নেই, নিয়নকে ঘরে ঢুকতে দেখে খুব রাগ দেখাতে ইচ্ছে করলো শিমুর।
‛কিরে আসলি যে আবার? খুব তো পাত্তাই দিলি না আমায়, বললি আর ফিরবি না।’
‛কাকা বললো কানতাছস নাকি, তাই আসলাম।’
‛কানতাছি না? তো আয়, কান্না থামা, পরে আবার চলে যা, যাহ।’
‛তুই তো কানতাছসই না, কাকা মিথ্যা বলছে। কাকা?’
সালাম শেখ পুকুর পাড় থেকে দৌড়ে আসলো।
আবার কি ঝামেলা পাকালি তোরা? এই দেহি কান্দছ, আবার এহন কি নিয়া ঝগড়া করছ?
‛আব্বা আমি কানছি কহন? তুমি মিথ্যা কইছো কেন নিয়নরে?’
সালাম শেখ শিমুর কোথায় জবাব দিলেন না। ব্রু কুঁচকে আবার বাইরে বেরিয়ে গেলেন। ততক্ষনে পারু বিবির গলার স্বর শোনা যাচ্ছে। চিৎকার চেঁচামেচি দেখে নিয়ন আর শিমুও বেরিয়ে এলো।
‛হায় আল্লাহ গো, আমার একটা মরিচ গাছও নাই এইখানে। গোড়া সহ তুইলা খাইয়া ফেলছে, কার গরু আইলো রে আল্লাহ, আমার একটা গাছও রাখলো না। আল্লাহ, তুমি বিচার কইরো গো আল্লাহ।’
পারু বিবিকে বিলাপ করতে দেখে শিমু হেসে দিলো। দাঁত চেপে হাসি থামিয়ে বললো,
‛এইটার জন্য তোমার কানতে হইবো মা? আবার লাগাইয়ো, নিয়ন আইনা দিবো নে তোমারে চারা।’
শিমুকে থামিয়ে পারু বিবি শাসিয়ে উঠলো,
‛অর কথা কি কছ তুই? কিছু করন লাগবো না অর। জমিদারগিরি পাইছে আমার বাড়িত আইসা। জমিদারগিরি লইয়া বাড়ি ছাড়তে ক। বইয়া বইয়া খাওন, আমার বাড়িতে চলবো না। আইছে কেন আবার? চইলা না গেলো সকালে একবার?’
পারু বিবির কথাগুলো শুনে শিমুর বিরক্তির সীমা রইলো না। পারু বিবির দিকে তেড়ে গিয়ে বললো,
‛মা তুমি নিয়নরে বকো কেন? তোমার আগের মরিচের চারাগুলা নিয়ন আইনা দেয়নাই? সারাদিন তো কম কাম করাও না অরে দিয়া, আবার কও জমিদার। জমিদাররা সারাদিন কাম করে?’
‛মুখে মুখে তর্ক করতে আইছ না। মাইনষের পোলাপাইনের লাইগা আমার এতো দরদ নাই। তোর দরদ লাগলে রাইন্দা খাওয়া গিয়া, আমি পারমু না। আইছে, দরদ কতো।’
চেঁচাতে চেঁচাতে পারু বিবি কলপাড়ে চলে গেলো। আরো কিছু বলার ইচ্ছে ছিলো শিমুর, কিন্তু হলো না। নিয়ন ততক্ষণে ঘরে চলে গেছে। শিমু রান্না ঘরে গেলো নিয়নের জন্য ভাত আনতে। ঘরে আসলেই ভাত বেশি নেই। দুপুরে নিয়নের জন্য রান্না হয়নি। শিমুও খায়নি। যা আছে, দুজনের তেমন হবে না। ডিমের তরকারিতে ডিমও একটা। শিমু তরকারি সহ সবগুলো ভাত প্লেটে নিয়ে নিয়নের ঘরে গেলো। কেমন ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হলো গালে, যেখানে চোখের জলের ছাপ থেকে গেছে। ইচ্ছে পূরণ করলো না শিমু। ভাতের প্লেটটা রেখে নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। শব্দ হলো না এই ঘরে অনেকক্ষন। চোখের জলের স্বাদ নিয়ন জানে। ভাতের প্লেট যখন খালি হলো, আরো কয়েকফোঁটা জল গাল বেয়ে শূন্য প্লেটে টপ টপ করে পড়তে লাগলো। টিনের চালের ছিদ্র দিয়ে ঘরে রোদ এসে প্লেটের উপর পড়তে লাগলো। স্টিলের প্লেটে গোল হয়ে পড়া রোদের আলোতে নিয়ন মুগ্ধ হয়ে দেখছে চোখের জলের সৌন্দর্য। বারান্দার ছোট্ট এই ঘরটাতে বৃষ্টির দিনে ছিদ্র বেয়ে পানি পরে। শীতের দিনে শিশির চুঁইয়ে পরে। তবুও নিয়নের মনে হয়, এই ঘরে শুধু মুগ্ধতা বসবাস করে। গ্রীষ্মের রোদ, শীতের শিশির কিংবা বর্ষার বৃষ্টিতে টিনের চাল ভেদ করে এ ঘরে সমস্ত মুগ্ধতারা ঢুকে। দুঃখগুলো উপভোগ করতে শিখে গেলে, আনন্দের মতন লাগে।







মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

এখনো ভালোবাসি তোমায়

বলতে পারিনি "ভালোবাসি"!

একটি প্রত্যাখানের গল্প: "তবুও ভালোবাসি"