শিমুল
শিমু বেশি সুন্দর নাকি শিমুল? না তো, শিমুল ফুল। শিমুল এখনো হয়নি। মাত্র তো ফুল ফুটেছে। একটাই শিমুল গাছ নদীর পাড়ে। জায়গার নামও শিমুল তলা। ফুলগুলো সরাসরি নদীতে গিয়ে পরে। বেশিক্ষন থাকে না, তলিয়ে যায়। তবুও গাছ থেকে পড়ার পর তলিয়ে যাওয়া অব্দি দেখতে খারাপ লাগে না। বেশিক্ষন ধরে দেখতে পারলে মুগ্ধতা থাকতো না। আচ্ছা, এতো মুগ্ধতা কেনো শিমুল ফুলে? শিমুল ফুল কি শিমুর চাইতে বেশি সুন্দর? কি অদ্ভুত ভাবনা! পেছন থেকে আবারও ডাকলো শিমু;
‛নিয়ন বাড়ি যাবি না?’
‛না, তুই যা। আর যাবো না তোদের বাড়ি।’
‛তোদের বাড়ি, তোদের বাড়ি বলছিস কেন? তোর বাড়ি না?’
‛তোদের ঘরে খাই ঘুমাই, আমার বাড়ি হয় কেমনে সেটা?’
শিমু সামনে এসে পাথরের ব্লকে পা ছড়িয়ে বসলো। শিমুল ফুলের সাথে শিমুর কোনো মিল নেই। শিমুলে ফুলের রঙ টকটকে লাল। শিমুর গায়ের রঙ টকটকে লাল কিংবা ফর্সা ও নয়। শ্যামবর্ণ। চোখগুলো ভাসা ভাসা। অসম্ভব মায়া চোখ দু’টোতে। কিন্তু চোখের মধ্যে মায়াটুকু কি শুধু নিয়নের জন্যই? নাকি সবার জন্য সমপরিমাণ মায়া দিয়ে চোখ বানিয়েছে বিধাতা? তাহলে কি শিমু মায়াবতী? মায়াবতীদের কথায় সহজে গলতে নেই। নিয়ন মুখ ফিরিয়ে থাকে। শিমু মুখোমুখি কথা বলার জন্য নিয়নের গালে হাত রেখে মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। নরম গলায় বললো,
‛আমার সাথে রাগ দেখাচ্ছিস কেনো বল তো? বকেছে তো মা।’
‛শুধু কি বকেছে? তোর সামনেই তো বললো, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে।’
‛তা তো প্রায় বলে, তাই বলে আর বাড়ি যাবি না? থাকবি কোথায়? খাবি কি?’
নিয়ন কথা বলে না। মুখ ফিরিয়ে দু’চোখ মেলে শিমুল গাছের দিকে তাকিয়ে থাকে। আবারও ভাবে; শিমুল ফুল কি শিমুর চাইতে বেশি সুন্দর? শিমুকে ছাড়া শুধু শিমুল ফুলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে এক জীবন পার করে দেওয়া যাবে। যদি যায়; তবে ফিরবে না আর শিমুদের ঘরে! শান্ত নদীর পাড়ে শিমুল ফুলে সমস্ত মুগ্ধতা ঢেলে দিয়ে দিব্বি কাটিয়ে দিবে একজীবন অনাহারে।
শিমু উঠে দাঁড়ায়। বলে,
‛আমি এখনো খাই নি নিয়ন। তুই ফিরলে তবেই খাবো।’
নিয়ন তাকিয়ে থাকে শিমুর চলে যাওয়াতে। ভাবে; পেটে ক্ষুধা থাকলে, মুগ্ধতা তখন পালিয়ে বেড়াবে। বসন্ত ফুরিয়ে গেলে শিমুল ফুলও ঝরে যাবে। তখন? সেই তো শিমুর কাছেই ফিরতে হবে! তার চেয়ে বরং আগেই ফেরা যাক! নিয়ন উঠতে চাইলে দেখে, শিমুর বাবা সালাম শেখ আসছে। শিমু নিশ্চিত বাড়ি গিয়ে বলেছে, নিয়ন ফিরতে চাইছে না। সালাম শেখ কাছাকাছি আসতেই নিয়ন উঠে দাঁড়ালো। কিছু বলার আগেই সালাম শেখ নিয়নের হাত ধরে ফেললো। বললো,
‛বাড়ি যাবি না কেন বাপ?’
নিয়ন তাকিয়ে রইলো সালাম শেখের দিকে। ভেজা চোখে কন্ঠস্বর নরম হয়ে এলো। বললো,
‛তুমি আমারে বাপ ডাকো কেন কাকা? কাকি তো বলে; আমার কেউ নাই, আমি অনাথ। অনাথ মানুষরে তুমি বাপ ডাকতে আইছো কেন?’
সালাম শেখ নিয়নকে বুকে জড়িয়ে নিলো। বললো,
‛তুই অনাথ কে কইছে রে বাপ? আমি আছি না? আয় বাড়ি আয়। তুই যাবি না বলছস দেইখা শিমু বাড়ি গিয়া কানতাছে।’
বুক থেকে ছাড়িয়ে দু’হাতে নিয়নের চোখের জল মুছে দিলো সালাম শেখ। নিয়ন শিমুল তলা পেছনে ফেলে কাকার হাত ধরে হাটতে লাগলো বাড়ির পথে। পথে পথে আবার ভাবতে লাগলো শিমুর কথা। শিমুর চোখে মায়া আসলে সবার জন্য সমান না, নিয়নের জন্য বেশি। নিয়নকে তাই ফিরতে হয় বার বার, ভেঙে অভিমান রাশি রাশি!
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন