সঙ্গোপনে ৬

গেটের সামনে লেখা বেবি কেয়ার ইউনিট। ভেতরে সামান্য ভিড়। ভিড় থাকাটাই স্বাভাবিক। প্রতিদিন নতুন নতুন মুখ নিয়ে অনেক নবজাতক প্রথমবারের মতো পৃথিবীর আলো দেখে এই ওয়ার্ডে। নবজাতকের চিৎকারে মায়ের মনে দুশ্চিন্তার মেঘ কাটে। নতুন অতিথিকে দেখতে আত্মীয় স্বজনের কমতি নেই। খাবার দাবার আসে সঙ্গে। কিন্তু নতুন অতিথির মুখে শুধু মায়ের বুকের শালদুধটুকুই জুটে। এক ভদ্রলোক মিষ্টির প্যাকেট হাতে এসে বললো,
‛ভাই। বাবা হইলাম, ধরেন।’
বলেই একটা মিষ্টি হাত বাড়িয়ে দিলো। হাসপাতালে অচেনা লোকের দেওয়া খাবার কেউ খেতে চায় না। কিন্তু এই ভদ্রলোক তার খুশিটা সবার মধ্যে বিলিয়ে দিতে চাইছেন। আমি এইটুকু খুশি ওনার কাছ থেকে নিবো না, তা কি করে হয়। মিষ্টিটা খেতে খেতে বললাম,
‛ভাই ছেলে বাবু না মেয়ে বাবু?’
চোখে মুখে খুশির আমেজ। বললো,
‛আল্লাহ আমারে জান্নাত দিছে ভাই। এই নিয়ে দুই মেয়ে হইলো।’
ওনার খুশি আমার মুখে ফুটালাম। হাসি দিয়ে বললাম, ‛যাক আলহামদুলিল্লাহ ভাই।’
ভাবলাম এইটুকু সখ্যতার খাতিরে ভদ্রলোক হয়তো আরেকটা মিষ্টি সাধবেন। তা হলো না। আমি ওয়ার্ডে গেলাম। দুদিনে চিত্রার শরীর কিছুটা ফুলে গেছে। স্যালাইনের প্রভাব। আগের রিপোর্ট অনুযায়ী কালকে ডেলিভারির তারিখ। আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টে আসছে ছেলে বাবু হবে। সমস্যা কিছুটা আছে। নরমাল ডেলিভারি হবে না। সেজন্য দুদিন আগেই হাসপাতালে এনে ভর্তি করিয়েছি। সিজার করাতে হবে। চিত্রার অনেক ভয়। অপারেশন থিয়েটারে যেতে চায় না। কিন্তু কিছু করার নেই। রিপোর্ট অনুযায়ী নরমাল ডেলিভারির সুযোগ নেই। কাল দুপুরে শেষবার দেখেছে চিত্রা আমাকে, আসলাম মাত্র। চিত্রার মুখে আর অভিমানের ছাপ নেই। ভয়ের ছাপ আছে। সময় বেশি নেই। তারপরেই মা হবার আনন্দময় মুহূর্ত টের পাবে। অপেক্ষা আনন্দের। তবুও চোখে ভয়। চিত্রা একপাশে সরতে চাইলো। বললো,
‛কি ভাবছো দাঁড়িয়ে? বসো।’
বসতে গিয়ে মন চায় শুয়ে পড়ি। শরীর ছেড়ে দিছে। একফোঁটাও শক্তি নেই আর। ঠিকমতো না ঘুমোতে পারলে আমি দুনিয়া অন্ধকার দেখি। ঘুমোতেই পারি নি গতরাতে। শহীদমিনারে পুলিশ এসে উঠিয়ে দিয়েছে রাত দশটার একটু আগে। হাসপাতালেই আসলাম। শোবার জায়গা পাইনি কোথাও। সিঁড়ির পাশের দেয়ালটাতেও লোকজন বসা ছিলো। শেষে জুতো বিছিয়ে বসে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে সারারাত পার করেছি। রাতে ঘুমও তেমন জোরালো ভাবে আসতে চায় নি। সন্ধ্যায় এতো কাপ চা খাওয়ার প্রভাবে হয়তো। ঘুমটা এখন টের পাচ্ছি। শরীর ভেঙে আসছে। পেটও তেমন ভরা না। সকালের খাবার বলতে এই একটা মিষ্টিই। খাবো ভাবছি, আগে চিত্রার সাথে দেখা করে নেই। এখন আর বাইরে বের হবো যে, সেই শক্তিটাও বোধহয় ফুরিয়ে গেছে। মন চায় চোখ বন্ধ করে চিত্রার সাথে বেডে শুয়ে পড়ি। লোকে যা ভাবে ভাবুক। চিত্রা আমার মতোই করবে তখন। লোকে কি ভাববে, সেদিকে মন নেই ওর। প্রিয় মানুষটাকে কাছে পেলে ওর আর কিচ্ছু চাই না। নিশ্চিন্তে আমার হাতটা ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলবে। বলবে, ‛এই দেখো না, বাবুটা কেমন নড়ছে।’ বলেই আমার হাতটা ওর পেটের উপর রাখবে। যদি বলি, ‛হ্যাঁ, নড়ছে তো।’ তাহলে ওর খুশি আর দেখে কে। হাত ছেড়ে ওর হাত রাখবে আমার গালে। এই সুযোগটা ও সবসময়ই খুঁজে। বলবে, ‛বাবু খেলতে থাকুক, এই সুযোগে আমরা প্রেম করি।’ দূর! কি ভাবছি। হাসপাতালে এসব করা যাবে না। তবে চিত্রা সত্যিই হাতটা ধরলো। বললো,
‛আজ এতো মনমরা যে? কি ভাবছো?’
শরীর খারাপ ছাড়াও মনটা তো আসলেই বিষণ্ণ। অনেক চিন্তাও মাথায় ভর করেছে। চিত্রার কাছে এসব লুকানো যাবে না। বললাম,
‛কালকে তোমার ডেলিভারির তারিখ। একা একা কিভাবে কি করবো বুঝতে পারছি না।’
চিত্রা শুধু তাকিয়েই আছে। কিছু বলতে পারছে না। হটাৎ কি ভেবে হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো। বললো,
‛খুব ভয় করছে আমার মিহির। চলো না বাসায় চলে যাই। আশেপাশে লোকজন তো থাকবে। নরমালি যা হবার তাই হবে।’
আমি আমার আরেকটা হাত রাখলাম ওর হাতে। বললাম,
‛কেনো ভয় হয় চিত্রা? এই দেখো, তাকাও আমার চোখে। তোমার মিহির তো আছে।’
চিত্রা আমার চোখে তাকিয়েছে ঠিকই, কিন্তু একটু শব্দ করেই কেঁদে দিয়েছে। এ কান্না মায়া মেশানো আছে।
ভালোবাসার কান্না। চিত্রা আরো কাছে চায় আমাকে। কপালে এইটুকু ভালোবাসার ছোঁয়া ছাড়া আমি আর কিই বা দিতে পারি এখানে। চুমুতে কি অঝোরে কান্না মিশে থাকে? থাকে হয়তো। চিত্রা কাঁদছে। আমি চোখের জল আটকাতে পারি না। মন চায় জড়িয়ে ধরে আজীবন কান্না করি। কিন্তু এ আমার দুর্বলতা; প্রিয় মানুষকে নিজের চোখের জল দেখাতে পারি না।
আমার কান্না তাই চিত্রা দেখে না। বেলকুনিতে এসে দাঁড়িয়েছি চিত্রাকে রেখে। গাছ, পাখি আর অপরিচিত সব মানুষেরা আমার কান্না দেখে!

দুপুর পেরিয়ে গেছে তাই ক্যান্টিনে ভিড় তেমন নেই। তবে বেশিরভাগ টেবিলেই মোটামুটি লোকজন আছে। কেউ কেউ চা খাচ্ছে। ভিড় না থাকার সুবিধার্থে কেউ বসে গল্প করার সুযোগ পাচ্ছে। ফাঁকা টেবিলেই বসেছি। কিন্তু কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না। চিত্রার ঠোঁটের স্বাদ এখনো ঠোঁটে লেগে আছে। কিছু খেতে গেলেই অনুভুতিটা নষ্ট হয়ে যাবে। আবার ক্ষুধাও লাগছে। সময় তো কম হয়নি। দুপুরে ডাক্তার এসে দেখে গেছেন চিত্রাকে। শরীরের কন্ডিশন মোটামুটি। পুরোনো রিপোর্ট গুলো দেখলেন। গত তিন মাসে একটাও পরীক্ষা করাই নি। সেজন্য অনেকটা রেগে গেলেন। বললেন,
‛এমনিতেই পেশেন্টের কন্ডিশন ভালো না, তারপর আবার আগের রিপোর্টে বেবির পজিশন ঠিকঠাক ছিলো না। পরে আরেকটা পরীক্ষা করানোর দরকার ছিলো না আপনাদের?’
গুছিয়ে উত্তর দেওয়ার সুযোগ পেলাম না। একটা কাগজে কিছু ঔষুধ আর ইনজেকশন লিখে দিয়ে বললেন,
‛এগুলো আনিয়ে রাখবেন। কাল নেওয়া হবে অপারেশন থিয়েটারে।’
কাগজটা ভাঁজ করতে করতে বের হচ্ছিলাম, ডাক্তার আবার ডাক দিলেন। কাছে যেতে বললেন,
‛রক্ত কিন্তু লাগতে পারে। ব্লাড ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ রাখবেন।’
কোনদিকে আগে যাবো ভেবেই পেলাম না। ভাবলাম কোথাও যাবো না এখন, চিত্রার কাছেই যাই। সকালে অনেকটা কেঁদেছে। চোখ মুখ এখনো ফোলা। এতক্ষন ওয়ার্ডে আমার যাবতীয় কার্যকলাপ দেখছিলো। কাগজটা পকেটে ভরে পাশে বসতেই জিজ্ঞেস করলো,
‛কি এটা?’
‛কিছু ঔষুধ আর ইনজেকশন আনিয়ে রাখতে বললো।’ ইনজেকশনের কথা বলতেই চিত্রার মুখটা কেমন গম্ভীর হয়ে গেলো। বললো,
‛ইনজেকশন না দিলে কি হয় না? যেটা ভয় পাই, সেটাই বার বার দিচ্ছে। বলোতো কেমন লাগে?’
‛আরে দূর। ব্যাথা আছে নাকি। এভাবে শুধু চোখ শুধু গুলো বন্ধ করে রাখবা ঠিকআছে?’ চিত্রার চোখের পাঁপড়ি গুলো আলতো ভাবে স্পর্শ করে বন্ধ করে দিলাম। চোখ বন্ধ অবস্থায় চিত্রা আমার হাত খুঁজে বের করলো। হাতটা কাছে নিয়ে দু হাতে শক্ত করে ধরলো। বললো,
‛যদি জানি আমার মিহির সামনে আছে, আমি আজীবন এভাবে চোখ বন্ধ করে নিশ্চিন্তে থাকতে পারি। কিন্তু মিহির তো থাকে না সামনে। আমি কিভাবে বলো চোখ বন্ধ করে রাখি?’
আমি একটু ঝুকে গেলাম ওর মুখের সামনে। আস্তে করে বললাম,
‛শুধু কালকের দিনটা। তারপর তোমার দুটো কাছের মানুষ হবে। একজন তো অন্তত তোমার কাছে সবসময় থাকবে।’
আমার নিঃশ্বাসের শব্দে চিত্রা বুঝে ফেলেছে আমি ওর কতোটা কাছে। হাত ছেড়ে দুহাত আমার গালে রাখলো। বললো,
‛কিন্তু আমার মিহিরকে একটু বেশি কাছে চাই।’
চিত্রা কাছে টানে নাকি আমিই কাছে যাই বুঝতে পারি না। শুধু মনে হলো; অনন্তকাল  ডুবে থাকতে চাই এমন নিশ্বাস ভারী করা চুম্বনে।
পেছন থেকে কে যেনো ডাক দিলো,
‛ভাইয়া প্লিজ, পেশেন্টের কাছে এভাবে আসবেন না।’
তাকিয়ে দেখি হাসপাতালের একজন সিনিয়র স্টাফ নার্স। আমার একটুও লজ্জা লাগলো না। কেউ ঐভাবে তাকিয়েও নেই আমাদের দিকে। চিত্রা অনেক্ষন পর চোখ খুললো। বললো,
‛আপু সরি, বুঝতে পারি নি আমরা।’
নার্স হাসি দিয়ে ফেললো। বললো,
‛আসলে হাসপাতাল তো। লোকে কি ভাববে।’
আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
‛ভাইয়া আবার পরে আইসেন, এখন যান।’
চিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। বুঝালো সুখী হয়েছে কাছে পেয়ে। কতোদিন পর তৃপ্তির হাসি ওর চোখে। কতো কতো সময় হলো, কাছে চেয়েও আসতে পারি নি দুজন কাছে। আজ যেটুকু পেয়েছি, আমারও ঐটুকুতেই সুখ। ওয়ার্ড ছেড়ে সোজা আসলাম ডক্টরস ক্যান্টিনে।
একটা ছেলে আসলো,
‛ভাই ভাত নাকি রুটি?’
ভাত বলতেই মাছের নাম বলতে শুরু করলো, ‛তেলাপিয়া, রুই, পাঙ্গাস, কই, পাবদা, চিংড়ি কোনটা খাইবেন ভাই?’
মাছ ছাড়া কি আছে?
‛ঝালফ্রাই আছে দিমু ভাই?’
‛দাও। ঝোল বেশি দিও আর ভাত দুই প্লেট।’
চাইলে সাথে ডাল নেওয়া যায়। মসুর ডাল। টেবিলের সামনে একটা ছোট বালতিতে রাখা আছে। ডালের জন্য অতিরিক্ত টাকা লাগবে না। সেজন্যই কেউ তেমন খায় না। ফ্রি জিনিসের প্রতি মানুষের আগ্রহ কম। কিন্তু তরকারিটা ঝালফ্রাই নামকরণে আমার সন্দেহ লাগছে। ঝালের চাইতে তরকারিতে মিষ্টি বেশি। পেঁয়াজ বেশি দেওয়ার কারণ। ভাবছিলাম তিন টুকরো মাংসের সাথে দুই প্লেট ভাত ঝোল দিয়ে মেখে খেয়ে ফেলতে পারবো। মাংস গুলো পেটে গেছে। ভাত আর খেতে মন চাইছে না। ভাতের দাম তুলনামূলক কম। নষ্ট করলে খুব বেশি খারাপ লাগবে না। বিল মেটাতে গিয়ে খেয়াল হয়, কেউ একজন খুব কাছে অধীর আগ্রহে আমার টাকা দেওয়াতে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা ভাত তরকারি টেবিলে নিয়ে দিয়েছে। আসার সময় একটা টিসু সাধলো। আমি তেমন বুঝি নি তখন। একটা চকচকে নোট ছিলো দশ টাকার। নোটটা ময়লা হলেও সমস্যা ছিলো না। ছেলেটা নিশ্চয় এই দশ টাকা জমিয়ে রাখতে চাইবে না। জমানো টাকা ভাঙতে মায়া লাগে। চিত্রার জমানো টাকা ভাঙছি, আমার মায়া লাগছে না!

খাওয়ার পর শরীর বিশ্রাম চায়। বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা আছে। চাইলে যেকোনো ওয়ার্ডের সামনে বারান্দায় ফ্লোরে শুয়ে পড়তে পারি। কেউ কিছু ভাববে না। না গোসল, না ঠিকমতো ঘুম। শরীরের পোশাক ময়লা। উস্কোখুস্ক চুল। সুবিধা এই; যেকোনো জায়গায় শুয়ে বসে কাটিয়ে দিতে দিতে পারি। ভদ্রলোকের বেশে আবার ফিরতে ইচ্ছে করে না। দুদিন পর লোকে পাগল ভাবতে শুরু করে দিবে। তাতেও আপত্তি নেই। চিত্রা ছাড়া কারো সামনেই প্রেমিক সাজতে ইচ্ছে করে না।

বিকেল বেলা বহির্বিভাগে তেমন ভিড় নেই। রোগী কম। পাঁচটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে ডাক্তারের জন্য। ক্যান্টিন থেকে ফিরে চিত্রার ওয়ার্ডে গিয়েছিলাম। যাওয়ার পথে মুখে হাসি দেখে গেলাম। এখন আবার কেমন গম্ভীর। ডাক্তার নাকি আবার এসে দেখে গেছে। চিত্রার বেডের পাশে আমাকে দেখে ওয়ার্ডের নার্স আসলো। বললো,
‛পেশেন্টের খবর রাখেন?’
আমি থতমত খেয়ে গেলাম। এ আবার কেমন প্রশ্ন! বললাম,
‛কেন, কি হইছে আপা?’
মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে যেতে যেতে বললো,
‛পাঁচটার পর ডাক্তারের সাথে দেখা করেন। বহির্বিভাগে, গাইনি ও প্রসূতি বিদ্যা বিভাগে তিন নম্বর রুমে।’
আমি দাঁড়ানো থেকে বেডের একপাশে বসে পড়লাম। কিছুই বুঝলাম না। ডাক্তার তো তখন তেমন কিছুই বললেন না। এখন আবার কি হলো। চিত্রার দিকে তাকিয়ে আরো বেশি মন খারাপ হলো। মুখটা কেমন বিষণ্ণ। বললাম,
‛চিন্তা করছো?’
‛নিজের জন্য না, তোমার জন্য করছি।’
আমি ওর হাতটা ধরে বললাম,
‛দূর। আমার জন্য আবার চিন্তা করতে হবে নাকি।’
‛একা কতো দৌড়াদৌড়ি করছো। চেহারা কি হইছে দেখছো?’
আমি মুখে হাত দিলাম। সমস্ত মুখে ধুলো আর আঠা আঠা। বললাম,
‛আরে হাসপাতাল তো, পানির ব্যবস্থা ভালো না। এইতো আর দুই তিন দিন মাত্র।’
চিত্রা হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে আমার চুলগুলো ধরতে চাইলো। বললো,
‛কাকের বাসা বানিয়ে রাখছো মাথায়। যাও, হাত মুখ ধুয়ে চুলে একটু পানি দিয়ে যাবা ডাক্তারের কাছে।’
নিজেও হাত দিলাম চুলে। বড় কম না। তার উপর এলোমেলো সব। কাকের বাসার মতোই দেখা যাচ্ছে হয়তো। হাসপাতালে আয়না নেই। আয়না থাকলে দেখতে পারতাম।

পুরুষের ওয়াশরুম, তারপরেও মহিলাদের ভিড়। মহিলাদের ওয়াশরুম নীচে। কষ্ট করে কেউ নিচে নামতে চায় না। কোনোরকম হাত পা ধুয়ে মাথায় একটু পানি দিয়ে বের হলাম। ভেজা চুল, তাও ঝামেলা। টপ টপ করে চুল বেয়ে পানি পড়ে। গামছা, রুমাল কিছু নেই। বাতাস থাকলে চুল শুকিয়ে যেতো। ফ্যানের নিচে বসার মতো জায়গা পাই, বহির্বিভাগে মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগে রোগীদের অপেক্ষাগারে।

মানসিক রোগীরা ভেতরে সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে যাচ্ছেন টিকিট হাতে। বাইরে থেকে বুঝবার উপায় নেই কে রোগী। রোগীর সাথে অভিভাবকও আছেন। রোগী কে, অভিভাবক কে, সেটা জানার উপায় নেই। একসাথে অনেকেই ঢুকে রুমে। সাইক্রিয়াটিস্ট একজনের পর একজনের সাথে কথা বলেন। আমি রুমে ঢুকে একটু পেছন দিকে দাঁড়ালাম। হাতে টিকিট নেই, তবুও অনেকে রোগীই ভাবলো। একটা অল্পবয়সী ছেলে সাইক্রিয়াটিস্টের সামনের চেয়ারে বসে আছে। বয়স ষোল কি সতেরো হবে। সামনে দাঁড়িয়ে ছেলেটার মা কথা বলছে।
‛স্যার, এতো পরিমান রাগ যে কিছুই বলা যায় না। বাইরে কারো সাথে ঝগড়া হলেও বাসায় এসে জিনিসপত্র ভাঙচুর করে। ওর বাবার গায়ে পর্যন্ত হাত দেয়।’
ছেলেটির মাকে অন্য একটি চেয়ারে বসতে বলে সাইক্রিয়াটিস্ট ড্রয়ার থেকে হাতুড়ি আর একটা তারকাটা হাতে নিলেন। ছেলেটাকে বললেন,
‛ধরো, এখন আমার প্রচুর রাগ উঠেছে। আমি তাই এই তারকাটাটা টেবিলে গাঁথবো।’
সাইক্রিয়াটিস্ট সত্যিই তারকাটা টা হাতুড়ি দিয়ে টেবিলে গেঁথে দিলেন। বললেন,
‛ধরো, আবার কিছুক্ষন পর আমার রাগ ভেঙে গেলো। এখন এই তারকাটাটা টেবিল থেকে খুলে ফেলবো।’
তারকাটাটা হাত দিয়ে টেনে টেবিল থেকে খুলে বললেন,
‛তারকাটা উঠালাম। কিন্তু গর্ত টা মুছতে পারলাম?’
ছেলেটা মাথা নাড়িয়ে না বোধক জবাব দিলো।
সাইক্রিয়াটিস্ট বললেন,
‛তুমি তো রেগে গিয়ে বাবা মা এবং সবার সাথে খারাপ ব্যবহার করো, কষ্ট দাও। দাও তো?’
ছেলেটা আবার হ্যাঁবোধক মাথা নাড়ালো।
সাইক্রিয়াটিস্ট বললেন,
‛আবার তোমার মন ভালো হয়ে গেলে তাদের সাথে যতোই ভালো ব্যবহার করো, তাদের মনে কিন্তু ঠিক এরকম একটা দাগ থেকে যায়।’
বলেই সাইক্রিয়াটিস্ট ছেলেটার গাল চাপড়ে দিলেন। বললেন,
‛রাগটা আস্তে আস্তে কমিয়ে ফেলো বাবা। একটু চেষ্টা করলেই পারবা।’
কিছু ঔষুধও লিখে দিলেন প্রেসক্রিপশনে।
ছেলেটার সাথে সাথে আমিও বের হয়ে এলাম বাইরে।সাইক্রিয়াটিস্টের রোগী দেখার ধরণটা অসাধারণ। আরো কিছুক্ষন থাকতে পারলে ভালো লাগতো। কিন্তু সময় নেই। পাঁচটা বেজে গেছে। গাইনি ও প্রসূতি বিদ্যা বিভাগে আর রোগী ঢুকছে না। রোগী দেখার সময় শেষ। আমি ভেতরে ঢুকতেই ডাক্তার চিনে ফেললেন। বললেন,
‛আবার ওয়ার্ডে গিয়ে তো আপনাকে পেলাম না। বসেন চেয়ারে।’
আমি চেয়ারে বসতেই উনি বললেন,
‛নিয়মিত অ্যান্টিনেটাল চেকআপগুলো করানোর দরকার ছিলো। এখন পরিস্তিতি তেমন ভালো না। পেশেন্টের উচ্চ রক্তচাপও আছে।’
আমি বললাম,
‛আগে তো ছিলো না।’
বললেন,
‛এখন আছে। বিষয়টা আরো আগে থেকে খেয়াল রাখার দরকার ছিলো।’
হটাৎ করে কেমন চিন্তা এসে ভর করলো মাথায়। জিজ্ঞেস করলাম,
‛এখন কোনো সমস্যা হবে স্যার?’
স্বাভাবিক ভাবেই জবাব দিলেন,
‛অস্ত্রোপচারের সময় বুঝা যাবে। আপনি রক্তের জোগান দিয়ে রাখেন।’
আরো একটা কাগজ হাতে দিয়ে বললেন,
‛এগুলো আনিয়ে রাখবেন।’
ডাক্তার ব্যাগ গুছিয়ে তারপর বের হবেন। আমি আগেই বেরিয়ে বসলাম চেয়ারে। মাথার উপর ফ্যানের শব্দটা কানে খুব বিধছে এখন। বাইরে ফার্মেসিতে যাবো নাকি এখানে বসে চিন্তাই করবো বুঝতে পারছি না। শেষ তিনমাস একবারের জন্যও চিত্রাকে নিয়ে যাই নি ডাক্তারের কাছে। মাঝখানে যে কয়বার সমস্যা হয়েছে, চিত্রাই যেতে চায় নি হাসপাতালে। প্রতিবার বলেছে, ‛পেটে বেবি থাকলে এরকম হবেই। দেখো নিজে নিজেই ঠিক হয়ে যাবে।’
সত্যি সত্যিই চিত্রার অসুস্থতা দীর্ঘস্থায়ী হতো না। সর্বোচ্চ দু একদিন, তারপর আবার সব ঠিকঠাক। সেজন্য আর আসাই হয়নি হাসপাতালে। বাসায় আরো নানান জটিলতাও ছিলো। অর্থনৈতিক সংকটও সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। চিত্রা সবকিছুই সামলেছে।

আগের বাসাটা ছেড়ে দিতে হয়েছিলো। নতুন বাসাটা অনেক ছোট। দক্ষিণের ঘরটাতে বেলকুনি আছে। বাকি একটা ঘরে খাওয়া দাওয়া হয়। একপাশে ছোট করে পড়ার ঘর বানিয়েছি। চিত্রা ওখানেই আবার ছবি আঁকা শুরু করেছে। বাচ্চাদের একটা ছবি আঁকার স্কুলে চাকরি নিয়েছে। সকালে দু ঘন্টা স্কুলে থাকে। ক্যাম্পাসে যাওয়ার আগে দুজনে মিলে রান্নাবান্না করি। পথে স্কুলে দিয়ে যাই। চিত্রা বাসায় আসে একা। আমার আসতে দেরি হয়। ক্লাস শেষে বিকেল পর্যন্ত একটা কোচিং সেন্টারে পড়াই। দুজনের ছোট্ট ইনকাম। মাস শেষে ছোট বাসাটার ভাড়া দেই। বাকিটা দিয়ে খাওয়া দাওয়া, দিব্যি চলে যায়। সপ্তাহে বৃহস্পতিবার আসলে ব্যাস্ততার কথা ভুলে যাই। পরদিন দুজনের ছুটি। রাত জাগি, প্রেম করি। বালিশের ন্যায় চিত্রা আমার বুকে মাথা রাখে। কতো কতো প্রেম মনে খেলা করে। সারারাত শরীরে শরীর লেপ্টে থাকে। ছুটির দিনে বিকেলে বের হই দুজনে। বাসার গলির রাস্তা দিয়ে বের হলে সোজা লেকের পাশে একটা বাগান আছে। বাদাম কিনে সেখানে বসি গিয়ে। বিশ টাকার বাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে চিত্রা আমার কাঁধে মাথা রাখে। কতো কতো কথা বলে। আকাশ মেঘলা দেখে হটাৎ চমকে উঠে। বলে,
‛এই দেখো না, বৃষ্টি হবে মনে হয়।’
আমি আকাশের দিকে তাকাই। বলি,
‛আসলে আসুক, বৃষ্টিতে ভিজবো।’
‛পাগল হইছো? আমার সিল্কের শাড়ি দেখো না?’
‛একদম পাগল হই নি। বৃষ্টি যদি আসেও, এই বাগানে তুমি আর আমি ছাড়া কেউ নেই। বৃষ্টিতে ভিজে প্রেম করবো।’
‛আরে চলো না। এতো হালকা শাড়িতে ভেজা যাবে না। বাসায় গিয়ে প্রেম করো চলো।’
চিত্রা আমার হাত ধরে টান মারতেই বেশ জোরে বজ্রপাত হয়। আবার নিজেই জড়িয়ে ধরে আমাকে। বলে,
‛চলো না, ভয় লাগে।’
‛আমি আছি না?’ বলে জড়িয়ে রাখি বুকে। বজ্রপাত থামলে চিত্রা নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। কিন্তু বৃষ্টি থামে না। অঝোর ধারায় পড়তে থাকে। দুজনে ভিজে একাকার। যখন বৃষ্টি থামে, গাছের পাতা বেয়ে টপ টপ করে মাথায় পানি পরে। এই দৃশ্য সুন্দর না হয়ে পারে না। আমি তার চেয়েও সুন্দর দৃশ্য দেখি চিত্রার দিকে তাকিয়ে। কপালের চুল বেয়ে পানি মাটিতে পড়ার আগে চোখের পাঁপড়ি স্পর্শ করে। এই সৌন্দর্য চিত্রাকে প্রকৃতি দিয়েছে। প্রকৃতি আমাকে মুগ্ধ হতে শিখিয়েছে। সেই প্রকৃতির নিয়ম ভঙ্গ করার ক্ষমতা আমার নেই। স্বাভাবিকভাবেই আরো বেশি কাছে যেতে চাই। একটু দূরে থাকতে চিত্রা বলে,
‛আমি জানতাম তুমি এমন করবে, তাই বলছি বাসায় যাই।’
আমি চিত্রার মুখে হাত দিয়ে কথা বলা বন্ধ করে দেই। বলি,
‛এতো সুন্দর দৃশ্য আমি বাসায় গেলে দেখতে পারতাম না।’
চিত্রা হাত ছাড়াতে চায় না। আরেকটু কাছে গিয়ে আমিই হাত সরাই নিজের প্রয়োজনে। চিত্রা পেছনে যেতে চায়, আমি হাত টেনে ধরি। বলি,
‛কোনো লুকোচুরি নয়। মেঘলা আকাশ, গাছ, পাখি সব সাক্ষী থাকবে আজ, তোমার আমার প্রেমে।’
চিত্রা আর পিছু যেতে চায় না। বলে,
‛এখানে?’
আমি হ্যাঁ বলতেই কেমন লজ্জা পায়, তা হাসিতেই স্পষ্ট টের পাওয়া যায়। বলে,
‛এই না না প্লিজ। বাসায় চলো।’
আমি কেমন তাকিয়ে থাকি চিত্রার দিকে। খুব আস্তে করি বলি,
‛না।’
এভাবে কথা বলার ধরণে প্রেম মিশে থাকে। চিত্রাও তাকিয়ে থাকে। আমি ধীরে ধীরে আরো সামনে যাই। কাছে খুব কাছে, যতটা কাছ থেকে চিত্রার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনা যায়। এতো কাছ থেকে চাইলেও কাউকে আর দূরে সরিয়ে দেওয়া যায় না। গাছ, পাখি, আকাশ সবাই দেখে, প্রেম কতোটা থাকে শরীরে। দুজোড়া ঠোঁট একসাথে অনেকক্ষন মিশে থাকে।

বাসায় গিয়ে চিত্রা অনেক বকা বকি করে। বলে,
‛যদি জ্বর ঠান্ডা লাগছে তো দেইখো। কি শখ রে বাবা, বৃষ্টিতে ভিজে প্রেম করবে।’
আমি বলি,
‛প্রেম তো অর্ধেক হইছে, বাকি অর্ধেক তো এখনো বাকি।’
‛হ্যাঁ, বাকি তো। আবার বৃষ্টি আসুক, তারপর ওই বাগানে গিয়েই বাকি অর্ধেক প্রেম করো। কেমন?’
আমি বুঝতে পারি এইটুকু রাগ ভাঙানোর জন্য কি করতে হবে। বলি,
‛তাহলে আমি বাগানে গিয়েই বসে থাকি। বৃষ্টি আসলে তুমি এসো, বাকি অর্ধেক প্রেম করে তখনি ঘরে ফিরবো।’
দরজার সামনে যেতেই চিত্রা দৌড়ে এসে হাত ধরে। বলে,
‛এই পাগল। প্রেম প্রেম করতে করতে রাত করে কই যাও?’
‛তাহলে তুমি দাও না কেনো?’
‛আরে যখনি করবে, সেই তো আমার সাথেই করবে। আমি ছাড়া আর তোমাকে প্রেম দিবে কে শুনি?’ বলেই টানতে টানতে নিয়ে যায় ভেতরে।
বাকি অর্ধেক প্রেম বাকি থাকে। বলে,
‛শুনো না, ওটা তো করা যাবে না এখন আর।’
‛করা যাবে না প্রেম?’ বিস্ময়ের সুরে বলি আমি। চিত্রা বিস্ময় আরো বাড়িয়ে দেয়। বলে,
‛না তো, বাকি অর্ধেকটা করা যাবে না। আবার অনেকদিন পর তোমার এই বাকি অর্ধেক প্রেম ফিরিয়ে দিবো, যখন আমরা তিনজন থাকবো।’
‛তিনজন?’ বলে চিত্রার দিকে তাকিয়ে থাকি অনেক্ষন। পরে নিজেই বুঝতে পারি, চিত্রা কি বুঝিয়েছে। জড়িয়ে ধরি। বলি,
‛কিভাবে বুঝলে তুমি?’
‛আজকেই টেস্ট করলাম সকালে।’
‛সারাটা দিন আমার কাছ থেকে এই সুন্দর মুহূর্তটা লুকালে?’
‛লুকালাম কই। বলতেই তো বাইরে বাগানে গেলাম তোমাকে নিয়ে। বৃষ্টি আসলো, আর তুমি পড়লে আকাশ বাতাস সাক্ষী রেখে প্রেম করতে।’
‛উফ, প্রেম তো করাই হলো না। এই চলো না প্রেম করি।’
চিত্রা আমার বুক থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। একগাল হেসে বলে,
‛পাগল একটা তুমি। সারাজীবন শুধু প্রেমই করবা হ্যাঁ? সংসার করতে হবে না?’
আলতো করে ঘাড়ে হাত রেখে চিত্রার কপালে চুমো এঁকে দেই। বলি,
‛এইতো আর কয়েকদিন মাত্র। তারপরেই হয়ে যাবে আমাদের তিনজনের ছোট্ট সংসার!’
চিত্রা আবার জড়িয়ে ধরে আমাকে। একজন আদর্শ প্রেমিকার কাছে পৃথিবীর সবচাইতে নিরাপদ আশ্রয় প্রেমিকের বুক!

চিত্রার গর্ভে আমার সন্তান! এটা প্রেমের ফসল। আমার মনে হয়ে সম্পর্কে কাছে আসতে, দুটো মানুষের মধ্যে গভীর প্রেমই যথেষ্ট। বৈধতা এখানে শুধু মাত্র দায়বদ্ধতা গড়ে তুলে। কাগজে বৈধতার স্বাক্ষর ছাড়াও সংসার হয়। কয়েকজন সাক্ষীর সামনে কবুল বলা কিংবা অগ্নিসাক্ষী রেখে সাত পাকে বাঁধার মধ্যে থাকা বৈধতার চুক্তির চেয়েও বড়; গভীর প্রেমে কাছে এসে সারাজীবন একসাথে থাকতে চাওয়ার বাসনা। আজন্ম স্বাদ ছিলো; প্রেকিক হবো। প্রেমে কোনো চুক্তিপত্র থাকতে হয় না!
এখানে সন্ধ্যা নামলে বেলকুনিতে দুটো চায়ের কাপ পাশাপাশি থাকে। টবে নয়নতারা ফুলের চারা দুটো মানুষের যত্নে বেড়ে ওঠে। রাত জাগা সকালে ভোরের পাখি দুটো মানুষকে একসাথে ছাদে দেখে। হাতে হাত রেখে কখনো বৃষ্টিতে ভিজে, চাঁদনী রাতে কখনো গায়ে জোৎস্না মাখে।
এখানে প্রেমের বাস মনে, শরীরে, সমস্ত ঘরে। ভেতরটা শূন্য লাগে, সমস্ত ঘর খালি লাগে একটা মানুষের অনুপস্থিতিতে। একজন কাঁদলে অন্যজনের চোখে জল গড়ে। দুজনের অট্টহাসিতে কখনো বা দেয়াল ফাটে। ভোরের নরম আলোয় ঘুম ভাঙা ঠোঁটে চুমু মিশে থাকে।
এখানে বৈধতার ছক নেই, চুক্তি নেই, প্রেম হয় সঙ্গোপনে!

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

এখনো ভালোবাসি তোমায়

বলতে পারিনি "ভালোবাসি"!

একটি প্রত্যাখানের গল্প: "তবুও ভালোবাসি"