সঙ্গোপনে ৪
যেভাবে ঘুমে চোখ বুজে আসছিলো, ভেবেছিলাম সারারাত ঘুম হবে। তেমনটা হয় নি। রাত তিনটার দিকেই ঘুম ভেঙে গেছে। আরো একটু হতো হয়তো, এক ভদ্রলোক জাগিয়ে না তুললে। যেভাবে চিত হয়ে শুয়েছিলাম দেয়ালের উপর, খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। একটু কাত হলেই সিঁড়িতে পরে যাওয়ার উপক্রম হতো। তাই হয়তো ভদ্রলোক ডাক দিয়ে জাগিয়ে দিলেন।
‛এই ভাই ঘুমাইতাছেন নাকি? উঠেন, পরবেন তো নিচে।’
কাঁধের উপর ভদ্রলোকের হাতের স্পর্শ পেয়ে যেই হাত পা ছড়াতে যাবো, ওমনি চোখ মেলতেই দেখি দেয়ালের উপরে কোনোরকম শুয়ে আছি। হটাৎ আতকে উঠি। এই রে, একটু ভালো ভাবে নড়াচড়া করলেই তো নীচে সিঁড়ির উপর পড়ে যেতাম। নাক মুখ ফাটতো নিশ্চিত। নিজে ইনজার্ড হলে অবস্থা খারাপ ছিলো। চিত্রার দেখাশুনার জন্য আমি আছি, আমাকে দেখবে কে।
দুইহাতে চোখ ঢলছিলাম। আমাকে ঘুমে কাতর দেখে ভদ্রলোক বললেন,
‛বেশি ঘুম আসলে নীচে একটা মাদুর বিছাইয়া ঘুমান ভাই। এমনে ঘুমাইলে তো নিচে পইরা মাথা ফাটাইবেন পরে।’
ঘড়ি দেখলাম, তিনটার বেশি বাজে। বললাম,
‛না ভাই থাক। আর ঘুমানো লাগবো না। এই রাত্র করে মাদুর পাবো কই আবার।’
ভদ্রলোক উনার সাথে আমাকে নিয়ে গেলেন। বললেন,
‛সারারাত এইখানে এমনে বইসা থাকবেন? চলেন আমার সাথে। আমার বাপ আর ভাই আছে ওখানে।’
বসলাম গিয়ে। গল্প হলো। ভদ্রলোকের নাম শরিফ। ছোট ভাইয়ের নাম সুজন। নরসিংদী থেকে এসেছেন বাবাকে গলায় টনসিলের অপারেশন করাতে। অপারেশন হয়েছে, প্রায় এক সপ্তাহ। ঔষুদপত্র লিখে দিয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছে সন্ধ্যায়। রাতটা থেকে সকালে চলে যাবেন বাড়িতে। হাসপাতালের মূল বারান্দায় একপাশের দেয়াল ঘেঁষে বড় করে একটা মাদুর পাতানো। পানির বোতল দেখে পানির তৃষ্ণা টের পেলাম। পানির বোতল হাতে নিতেই শরিফ ভাই দুইটা কলা আর একটা পাউরুটির প্যাকেট এগিয়ে দিলেন। হাসপাতালে শুকনো খাবার বলতে এই কলা রুটিই। মোটামুটি সবার বিছানাতেই কলা রুটি চোখে পড়বার মতো। অপরিচিত কেউ খাবার সাধলে সঙ্গে সঙ্গে হাতে নিয়ে খেতে শুরু করবো, এরকমটা আমার সাথে মানায় না। আজ হঠাৎ কি হলো বুঝলাম না। শরিফ ভাইয়ের হাত থেকে কলা রুটি নিয়ে গেগ্রাস গিলতে থাকলাম। পরক্ষনে বুঝতে পারলাম রাতে কিছুই খাওয়া হয় নি। চিত্রার জন্য মন খারাপ লাগছিলো। খাবারের কথা মনে ছিলো না। ক্ষুধার্ত মানুষের চেহারায় ক্ষুধার ছাপ থাকে। শরিফ ভাই বুঝতে পারছিলেন হয়তো। পেটে ক্ষুধা কিন্তু মুখে স্বাদ নেই। ঘুম ঠিকমতো হয় নি, তাই হয়তো। তবুও খারাপ না। ক্ষুধা মিটলেই হলো। শরিফ ভাই বললেন,
‛সকালে তো চইলাই যামু ভাই। আমার মাদুরটা আপনে রাইখা দিয়েন। রাত্রে একপাশে বিছাইয়া ঘুমাইয়া থাকবেন।’
‛থাক ভাই ঝামেলার দরকার নেই। হাতে মাদুর নিয়ে ঘুরতে হবে পরে।’ বললাম আমি।
শরীফ ভাই ব্রু কুঁচলালেন। বললেন,
‛এইটা কোনো কথা? ফ্লোরে ফ্লোরে ঘুমাইবেন নাকি?’
‛তা নয়। তবে আমার মনে হয় আশ্রয়ের জন্য প্রতিদিন আপনার মতো কাউকে না কাউকে ঠিক পেয়ে পেয়ে যাবো। হা হা হা।’
শরীফ ভাইও হাসলেন খানিকটা। মাদুরটা ভাঁজ করে রশি দিয়ে বেঁধে দিলাম। ভোর ছয়টায় হাসপাতালের দু নম্বর গেট থেকে ওনাদেরকে সাইনবোর্ডের গাড়িতে তুলে দিয়েছি। সাইনবোর্ড থেকে নরসিংদীর গাড়ি পাওয়া যায়। মন খারাপ লাগছিলো। হাসপাতালে এরকম মানুষ খুব একটা পাওয়া যায় না।
রাতে অনেকটা সময় ওনাদের সাথে কাটিয়েছি। মনে হলো খুব আপন মানুষগুলো কাছ থেকে দূরে চলে গেলো। শহরে চিত্রা ছাড়া আর আপন কেউ নেই। তাই অল্প পরিচয়ে কেউ কাছে আসলেও বড্ড আপন মনে হয়। কিন্তু খানিক বাদেই দেখি আবার কেউ নেই।
এখান থেকে চিত্রার ওয়ার্ড বরাবর দেখা যায়। রাতে যেখানে ঘুমিয়েছিলাম, সেখানেই দেয়ালটা ফাঁকা ছিলো। শরিফ ভাইদেরকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে এসে বসেছি। আটটা বাজা অব্দি অপেক্ষা করতে হবে। ওয়ার্ডের সামনে একটা গেট আছে। আনসারের লোকজন গেটে পাহারা দেয়। আটটা বাজলে পুরুষ মানুষ ঢুকতে দিবে। এই কথাটাও চিত্রা জানে না। এতোটা সকাল হয়ে গেছে আমি যাই নি, আবার গাল ফুলাবে। অভিমান করবে কিন্তু মুখে কিছু বলবে না। কাছে যেতেই চোখের জলে গাল ভাসাবে। যতো তাড়াতাড়ি যেতে পারবো, চিত্রার অভিমান ততো তাড়াতাড়ি ভাঙবে। ব্যাপারটা আমার নিজের হাতে নেই। তবুও চেষ্টা করতে তো বাধা নেই। গেটের কাছে যেতেই এক আনসার সদস্য কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠলো,
‛আপনাদের দৈর্য্য বলতে কিছু নাই নাকি? আটটা বাজতে আর কতোটুকু সময় আছে? তাও গেটের কাছে এসে ঘুরঘুর করতেছেন। যান, আটটা বাজে আইসেন।’
এসব কড়া কথায় মন খারাপ করলে হবে না। আটটা পর্যন্ত ঢুকতে না দেওয়া ওনাদের ডিউটি। আমি আসছি নিয়মের বাইরে একটু বাড়তি চেষ্টা করতে। কাছে গিয়ে বললাম,
‛ভাই রোগী ভেতরে একা। সাথে কেউ নেই। সারারাত তো ছিলাম না। একটু ঢুকতে দিলে খুব উপকার হতো।’
একটু আগে কর্কশ কণ্ঠে শাসানো মানুষটা হটাৎ যেনো আলাদা মানুষ হয়ে গেলো। আর কিছুই বললো না, গেট খুলে দিলো।
ভেবেছিলাম চিত্রা হয়তো জেগে আছে। কিন্তু না। ঘুমোচ্ছে। জায়গা পরিবর্তন হয়েছে। ওয়ার্ডের কিনারে সম্পূর্ণ আলাদা একটা বেডে। তারমানে ওই নার্স আপাই এই ব্যবস্থা করে দিয়েছে। চিত্রার পাশে এসে দাঁড়াতেই নার্স আপা সামনে দাঁড়িয়ে। ওনার টাকাটা দিতে হবে। দুইটা একশো টাকার নোট। হাতে দিতে গিয়ে মনে পড়লো আগে একশো টাকা এডভান্স দিয়ে দিয়েছিলাম। তবুও মাঝপথে এভাবে একটা নোট আবার ফিরিয়ে এনে পকেটে ভরা ঠিক হবে না। দুটো নোটই দিয়ে ফেললাম। টাকা গুলোর চাইতে নার্স আপার চোখগুলোই বেশি চকচক করছে। এতো অসুন্দর দৃশ্য আমি আগে কখনো দেখি নি। চোখ ফিরিয়ে বললাম,
‛আপা খুব উপকার হলো। ধন্যবাদ আপনাকে।’
পার্স ব্যাগে নোট দুটো ঢুকাতে ঢুকাতে বললো,
‛আবার কোনো কাজে লাগলে ডাক দিবেন। টাকা যা দেওয়ার দিবেন, কিন্তু কাজ একদম খাঁটি পাইবেন।’
কবিতা আবৃত্তির ভঙ্গিমায় লাস্ট কথাটা বলে চলে গেলো। বসলাম চিত্রার পাশে। এবার আর কেউ এসে জাগাতে নিষেধ করলো না। একটা হাত ধরে অন্য হাতে গালে আস্তে করে স্পর্শ করে ডাক দিলাম,
‛চিত্রা?’
কণ্ঠস্বর শুনেই কোনোরকম নড়াচড়া না করে সরাসরি চোখ খুলে ফেললো। কণ্ঠস্বর খুব কঠিন।
‛কোথায় ছিলে?’
থতমত খেয়ে গেলাম। এতো কঠিন করে বলা প্রশ্নে নরম গলায় উত্তর দেওয়া যায় না।
বললাম,
‛ওরা ঢুকতে দিচ্ছিলো না ভেতরে আটটার আগে।’
ঝাঁকি দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
‛রাতে এভাবে একা রেখে চলে গেলা?’
আমি কি উত্তর দিবো। সত্যটাই বললাম, তবে একটু কর্কশ গলায়।
‛আমি কি করবো? রাতে এখানে পুরুষ মানুষ থাকতে দেয় না।’
চিত্রা মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিয়েছে। এটা সহ্য করা যায় না। না বুঝে শুধুই মায়া কান্না কাঁদবে। এখন আর এখানে থাকা যাবে না। চিত্রাকে আরো কষ্ট দিয়ে ফেলবো। রাগ উঠলে এসব মায়া কান্নায় আমার মন গলে না। উল্টো রাগ বাড়ে। শুধু আজ না। চিরকাল আমি এমনই ছিলাম!
বাসায় সকালে নাস্তা তৈরি হতো না। চিত্রা ঘুম থেকে উঠে দেরিতে। রুপম বাবু নিজেই চা করে টোস্ট ভিজিয়ে খেয়ে বেরিয়ে পড়েন। আমার খাবার একই। সেজন্য কষ্ট করতে হয় না। রুপম বাবুই বেশি করে চা বানান। চিত্রা দুপুরে রান্না করে। সপ্তাহে চার দিন আমার ক্লাস থাকে। বাকি দিনগুলোতে চিত্রার সাথে রান্নাঘরে থাকি। পেঁয়াজ মরিচ কেটে দেই। চিত্রা ছোটবেলার গল্প বলে। গল্পের ফাঁকে কখনো তরকারিতে লবন কম বেশি দিয়ে ফেলে। তাতে ঝামেলা তেমন একটা হয় না। রান্না যেমনই হোক, রুপম বাবু খাবার টেবিলে একটা কথাও বলেন না। আমি বলি। সব কাজেই প্রশংসা পাওয়ার মতো অদ্ভুত এক ক্ষমতা নিয়ে রূপবতী মেয়েরা জন্মায়। সেজন্য স্বাদ যেমনই হোক, রূপবতী মেয়েদের রান্নার প্রশংসা না করে পারা যায় না। বলি,
‛তুমি যা রান্না করো না চিত্রা, কি আর বলবো। কোথায় শিখলে বলোতো এতো সুন্দর রান্না?’
চিত্রা বিরক্তি দেখায়। বলে,
‛পাম মারবা না তো, চুপচাপ খাও।’
আমি একদম চুপচাপ খেতে পারি না। চিত্রার তথাকথিত পাম মারা ছাড়াও আরো অনেক কথা বলি। আমার ছোটবেলার কথা বলি। ছোটবেলায় একবার চরমোনাই মাহফিলে গিয়েছিলাম। বাড়ি থেকে শুধু চিড়া, মুড়ি গুড় ইত্যাদি সব শুকনো খাবার নিয়ে গিয়েছিলাম। তিন দিন ছিলাম সেখানে, এগুলোই খেতাম। শেষের দিন এক লোকের থালায় পটল দিয়ে টেংর মাছের তরকারি দেখলাম। আমারও পটল দিয়ে টেংরা মাছের তরকারি খেতে খুব ইচ্ছে হলো। চরমোনাই থেকে সেদিন বাড়ি ফেরার পর আরো নয় বছর কেটে গেছে, পটল দিয়ে টেংরা মাছের তরকারি খাওয়ার ইচ্ছে পূরণ হয় নি। এই তরকারিটার কথা মনে হলেই আমার মুখ কেমন থমথমে হয়ে যায়। চিত্রা তখন হাসতে চায়। হাসি আটকাতে না পেরে ভাত মুখে কাশতে শুরু করে। আমার গল্প থেমে যায়।
‛এভাবে হাসলে আর কিছু বলবো না যাও।’
চিত্রা পানি খেয়ে নিজেকে শান্ত করে। তবুও ঠোঁটে হাসি লেগে থাকে। বলে,
‛যেভাবে কান্না করে দিতেছো, হাসবো না তো কি করবো বলো?’
আমি গাল ফুলিয়ে অভিমানী কণ্ঠে বলি,
‛আমি কাঁদলে তোমার হাসি পায় বুঝি?’
চিত্রা আবার হাসে। দাঁত চেপে হাসে। বলে,
‛শুনো, তোমার কান্না দেখে আমার একটু ও হাসি পাচ্ছে না। তোমার বাচ্চামি দেখে হাসছি। একটা তরকারির জন্য কেউ এভাবে মন খারাপ করে?’
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াই। মাথাটা একটু ওর দিকে ঝুঁকিয়ে নিয়ে বলি,
‛তাহলে শুনো, তুমিই আমাকে এই তরকারিটা রান্না করে খাওয়াও।’
চিত্রা হাসে। জোরে হাসে। হাসির ঝনঝন শব্দ কানে বাজে। আমার আর মন খারাপ থাকে না, তবুও বাড়তি অভিমান দেখাই। রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেই। তবুও হাসি থামে না। আমার মনে হয় এই হাসি আর না থামুক। চিরকাল এইরকম ঝনঝন শব্দ কানে বাজুক। ভাবতে ভাবতে আমি ঘুমিয়ে যাই। ঘুমের মধ্যে ও চিত্রা হাসে। দাঁত বের করে হাসে। সুন্দর হাসি। কাছে গিয়ে মানুষটাকে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হয়। কেনো এমন হয়?
পরদিন সকালে চিত্রা হাতে বাজারের লিস্ট ধরিয়ে দেয়। লিস্ট পড়তে গিয়ে দেখি সবার উপরে টেংরা মাছ আর পটলের নাম লেখা। চিত্রা মুচকি হাসে। আমারও হাসি পায়। অনেক জোরে হাসি পায়। আমার হাসিও কি চিত্রার কানে বাজে? আমি জানি না।
ওয়্যারড্রোবে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় টাকা রাখা থাকে। রুপম বাবু রেখে দেন। বাজারের টাকা। আমি বাজারের বাইরে অতিরিক্ত চল্লিশ টাকা খরচ করি। চিত্রার জন্য বিশ টাকার বিশ টাকার করে চটপটি আর ফুসকা আনি। বাঙালি মেয়েদের প্রিয় খাবার। কলকাতার মেয়ে হলেও তো চিত্রা বাঙালি। ওর এসব আরো বেশি প্রিয়। আমার ভালো লাগে না। কিসব তেতুলের টক, আমার কাছে বিচ্ছিরি লাগে। আমার কাছে ভালো লাগে ওর খাওয়া দেখতে। সময় নিয়ে বাচ্চাদের মতো খায়। রান্নায় দেরি হয়, ঝামেলা এই। দুপুরের খাবার তৈরি হতে হতে প্রায় বিকেল। পটল দিয়ে টেংরা মাছ। রুপম বাবু চুপচাপ খান। একটা কথা ও বলেন না। আমি খেতে পারি না। পটলের ভেতর এতো বিচি, খুবই বিচ্ছিরি ব্যাপার। নয় বছরে যা খাওয়ার ইচ্ছা পূরণ হয় নি, আজীবন তা অপুরণীয় থাকলেই বোধহয় ভালো হতো। পটলের প্রতি আমার মুগ্ধতা থাকতো। এখন মুগ্ধতা কেটে গেছে। একদম কেটে গেছে। খুব বেশি প্রিয় জিনিসের কাছে যেতে নেই। তাতে রহস্য থাকে না। রহস্য ফুরিয়ে গেলে প্রিয় জিনিসটা আর আগের মতো প্রিয় থাকে না। পটলের তরকারি এখন আর খেতে মন চাইছে না। চিত্রাকে এটা বলা যাবে না। বললে হাসবে আবার। সে হাসিতে ঝনঝন শব্দ হবে। আমি তা ফেলে রেখে ঘর থেকে বেরুতে পারবো না। আমাকে বেরুতে হবে। পাঁচটার মধ্যে রুবিদের বাসায় পৌঁছাতে হবে। নিজে বিবিএর ছাত্র হয়ে ও রুবিকে ফিজিক্স কেমিস্ট্রি পড়াই। ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত সাইন্স নিয়ে পড়েছি, তাতেই ভদ্রমহিলা সাহস করে আমার কাছে মেয়েকে পড়তে দিয়ে দিয়েছেন। রুবি হলিক্রসে পড়ে ক্লাস নাইনে। গার্লস স্কুলের মেয়েদের জন্য কখনো ছেলে হোমটিউটর রাখতে নেই। তাতে বিপদ আছে। বিপদটা আমি জানতাম না। রুবির মা নিজেই আমাকে একদিন জানিয়ে গেছেন। রুবির বান্ধবী মিতু ক্লাস এইটে জেএসসি পরীক্ষার আগে ইন্টারে পড়ুয়া হোম টিউটরের সাথে পালিয়ে গেছে। তিন দিন পর মিতুর খোঁজ মিললো, ওই হোম টিউটরের বাড়ি নওগাঁতে। ঢাকা থেকে পালিয়ে দুজনে নওগাঁয় গিয়ে বিয়ে করেছে। নওগাঁ থেকে মিতুকে পরে ওর বাবা মা ঢাকায় নিয়ে এসেছে। মিতু নাকি পরে স্বীকার করেছে, পরীক্ষায় ভালো প্রস্তুতি ছিলো না বলেই পালিয়ে গেছে। এটা সত্যি নাইন টেনের বয়সে মেয়েদের শরীরে প্রেম আসে। সেজন্য এই বয়সেই মেয়েরা প্রেমিক খুঁজতে থাকে। এই কাজে গার্লস স্কুলের মেয়েদের কষ্ট বেশি। ক্লাসে ছেলে থাকলে প্রেম করতে সুবিধা। এই বয়সের প্রেম অনেক বেশি শরীর চায়। স্কুলে ছেলে থাকলে যখন তখন ছোঁয়া যায়, এই সুবিধা। গার্লস স্কুলে এই সুবিধা নেই। সেজন্য কেউ কেউ হোমটিউটরের প্রেমে পড়ে। আমি এসবে ভয় পাই না, রুবিকে আরো বেশি কাছে টানি। ফিজিক্স কেমিস্ট্রির বাইরেও শ্রদ্ধা, সম্মান ভালোবাসা শিখাই। রুবি আমাকে ভালোবাসে, কিন্তু শিক্ষক হিসেবে। পড়ানো শেষ হলে রুবি আমাকে ওর বেলকুনিতে নিয়ে যায়। গাছের টবে পানি দেয়। আমিও সাথে দেই। ছাদে নিয়ে রুবি আমার হাত ধরে আকাশ দেখে। সে স্পর্শে কামনা থাকে না, সম্মান থাকে। আমার শেখানো সম্মান!
‛এই ভাই ঘুমাইতাছেন নাকি? উঠেন, পরবেন তো নিচে।’
কাঁধের উপর ভদ্রলোকের হাতের স্পর্শ পেয়ে যেই হাত পা ছড়াতে যাবো, ওমনি চোখ মেলতেই দেখি দেয়ালের উপরে কোনোরকম শুয়ে আছি। হটাৎ আতকে উঠি। এই রে, একটু ভালো ভাবে নড়াচড়া করলেই তো নীচে সিঁড়ির উপর পড়ে যেতাম। নাক মুখ ফাটতো নিশ্চিত। নিজে ইনজার্ড হলে অবস্থা খারাপ ছিলো। চিত্রার দেখাশুনার জন্য আমি আছি, আমাকে দেখবে কে।
দুইহাতে চোখ ঢলছিলাম। আমাকে ঘুমে কাতর দেখে ভদ্রলোক বললেন,
‛বেশি ঘুম আসলে নীচে একটা মাদুর বিছাইয়া ঘুমান ভাই। এমনে ঘুমাইলে তো নিচে পইরা মাথা ফাটাইবেন পরে।’
ঘড়ি দেখলাম, তিনটার বেশি বাজে। বললাম,
‛না ভাই থাক। আর ঘুমানো লাগবো না। এই রাত্র করে মাদুর পাবো কই আবার।’
ভদ্রলোক উনার সাথে আমাকে নিয়ে গেলেন। বললেন,
‛সারারাত এইখানে এমনে বইসা থাকবেন? চলেন আমার সাথে। আমার বাপ আর ভাই আছে ওখানে।’
বসলাম গিয়ে। গল্প হলো। ভদ্রলোকের নাম শরিফ। ছোট ভাইয়ের নাম সুজন। নরসিংদী থেকে এসেছেন বাবাকে গলায় টনসিলের অপারেশন করাতে। অপারেশন হয়েছে, প্রায় এক সপ্তাহ। ঔষুদপত্র লিখে দিয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছে সন্ধ্যায়। রাতটা থেকে সকালে চলে যাবেন বাড়িতে। হাসপাতালের মূল বারান্দায় একপাশের দেয়াল ঘেঁষে বড় করে একটা মাদুর পাতানো। পানির বোতল দেখে পানির তৃষ্ণা টের পেলাম। পানির বোতল হাতে নিতেই শরিফ ভাই দুইটা কলা আর একটা পাউরুটির প্যাকেট এগিয়ে দিলেন। হাসপাতালে শুকনো খাবার বলতে এই কলা রুটিই। মোটামুটি সবার বিছানাতেই কলা রুটি চোখে পড়বার মতো। অপরিচিত কেউ খাবার সাধলে সঙ্গে সঙ্গে হাতে নিয়ে খেতে শুরু করবো, এরকমটা আমার সাথে মানায় না। আজ হঠাৎ কি হলো বুঝলাম না। শরিফ ভাইয়ের হাত থেকে কলা রুটি নিয়ে গেগ্রাস গিলতে থাকলাম। পরক্ষনে বুঝতে পারলাম রাতে কিছুই খাওয়া হয় নি। চিত্রার জন্য মন খারাপ লাগছিলো। খাবারের কথা মনে ছিলো না। ক্ষুধার্ত মানুষের চেহারায় ক্ষুধার ছাপ থাকে। শরিফ ভাই বুঝতে পারছিলেন হয়তো। পেটে ক্ষুধা কিন্তু মুখে স্বাদ নেই। ঘুম ঠিকমতো হয় নি, তাই হয়তো। তবুও খারাপ না। ক্ষুধা মিটলেই হলো। শরিফ ভাই বললেন,
‛সকালে তো চইলাই যামু ভাই। আমার মাদুরটা আপনে রাইখা দিয়েন। রাত্রে একপাশে বিছাইয়া ঘুমাইয়া থাকবেন।’
‛থাক ভাই ঝামেলার দরকার নেই। হাতে মাদুর নিয়ে ঘুরতে হবে পরে।’ বললাম আমি।
শরীফ ভাই ব্রু কুঁচলালেন। বললেন,
‛এইটা কোনো কথা? ফ্লোরে ফ্লোরে ঘুমাইবেন নাকি?’
‛তা নয়। তবে আমার মনে হয় আশ্রয়ের জন্য প্রতিদিন আপনার মতো কাউকে না কাউকে ঠিক পেয়ে পেয়ে যাবো। হা হা হা।’
শরীফ ভাইও হাসলেন খানিকটা। মাদুরটা ভাঁজ করে রশি দিয়ে বেঁধে দিলাম। ভোর ছয়টায় হাসপাতালের দু নম্বর গেট থেকে ওনাদেরকে সাইনবোর্ডের গাড়িতে তুলে দিয়েছি। সাইনবোর্ড থেকে নরসিংদীর গাড়ি পাওয়া যায়। মন খারাপ লাগছিলো। হাসপাতালে এরকম মানুষ খুব একটা পাওয়া যায় না।
রাতে অনেকটা সময় ওনাদের সাথে কাটিয়েছি। মনে হলো খুব আপন মানুষগুলো কাছ থেকে দূরে চলে গেলো। শহরে চিত্রা ছাড়া আর আপন কেউ নেই। তাই অল্প পরিচয়ে কেউ কাছে আসলেও বড্ড আপন মনে হয়। কিন্তু খানিক বাদেই দেখি আবার কেউ নেই।
এখান থেকে চিত্রার ওয়ার্ড বরাবর দেখা যায়। রাতে যেখানে ঘুমিয়েছিলাম, সেখানেই দেয়ালটা ফাঁকা ছিলো। শরিফ ভাইদেরকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে এসে বসেছি। আটটা বাজা অব্দি অপেক্ষা করতে হবে। ওয়ার্ডের সামনে একটা গেট আছে। আনসারের লোকজন গেটে পাহারা দেয়। আটটা বাজলে পুরুষ মানুষ ঢুকতে দিবে। এই কথাটাও চিত্রা জানে না। এতোটা সকাল হয়ে গেছে আমি যাই নি, আবার গাল ফুলাবে। অভিমান করবে কিন্তু মুখে কিছু বলবে না। কাছে যেতেই চোখের জলে গাল ভাসাবে। যতো তাড়াতাড়ি যেতে পারবো, চিত্রার অভিমান ততো তাড়াতাড়ি ভাঙবে। ব্যাপারটা আমার নিজের হাতে নেই। তবুও চেষ্টা করতে তো বাধা নেই। গেটের কাছে যেতেই এক আনসার সদস্য কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠলো,
‛আপনাদের দৈর্য্য বলতে কিছু নাই নাকি? আটটা বাজতে আর কতোটুকু সময় আছে? তাও গেটের কাছে এসে ঘুরঘুর করতেছেন। যান, আটটা বাজে আইসেন।’
এসব কড়া কথায় মন খারাপ করলে হবে না। আটটা পর্যন্ত ঢুকতে না দেওয়া ওনাদের ডিউটি। আমি আসছি নিয়মের বাইরে একটু বাড়তি চেষ্টা করতে। কাছে গিয়ে বললাম,
‛ভাই রোগী ভেতরে একা। সাথে কেউ নেই। সারারাত তো ছিলাম না। একটু ঢুকতে দিলে খুব উপকার হতো।’
একটু আগে কর্কশ কণ্ঠে শাসানো মানুষটা হটাৎ যেনো আলাদা মানুষ হয়ে গেলো। আর কিছুই বললো না, গেট খুলে দিলো।
ভেবেছিলাম চিত্রা হয়তো জেগে আছে। কিন্তু না। ঘুমোচ্ছে। জায়গা পরিবর্তন হয়েছে। ওয়ার্ডের কিনারে সম্পূর্ণ আলাদা একটা বেডে। তারমানে ওই নার্স আপাই এই ব্যবস্থা করে দিয়েছে। চিত্রার পাশে এসে দাঁড়াতেই নার্স আপা সামনে দাঁড়িয়ে। ওনার টাকাটা দিতে হবে। দুইটা একশো টাকার নোট। হাতে দিতে গিয়ে মনে পড়লো আগে একশো টাকা এডভান্স দিয়ে দিয়েছিলাম। তবুও মাঝপথে এভাবে একটা নোট আবার ফিরিয়ে এনে পকেটে ভরা ঠিক হবে না। দুটো নোটই দিয়ে ফেললাম। টাকা গুলোর চাইতে নার্স আপার চোখগুলোই বেশি চকচক করছে। এতো অসুন্দর দৃশ্য আমি আগে কখনো দেখি নি। চোখ ফিরিয়ে বললাম,
‛আপা খুব উপকার হলো। ধন্যবাদ আপনাকে।’
পার্স ব্যাগে নোট দুটো ঢুকাতে ঢুকাতে বললো,
‛আবার কোনো কাজে লাগলে ডাক দিবেন। টাকা যা দেওয়ার দিবেন, কিন্তু কাজ একদম খাঁটি পাইবেন।’
কবিতা আবৃত্তির ভঙ্গিমায় লাস্ট কথাটা বলে চলে গেলো। বসলাম চিত্রার পাশে। এবার আর কেউ এসে জাগাতে নিষেধ করলো না। একটা হাত ধরে অন্য হাতে গালে আস্তে করে স্পর্শ করে ডাক দিলাম,
‛চিত্রা?’
কণ্ঠস্বর শুনেই কোনোরকম নড়াচড়া না করে সরাসরি চোখ খুলে ফেললো। কণ্ঠস্বর খুব কঠিন।
‛কোথায় ছিলে?’
থতমত খেয়ে গেলাম। এতো কঠিন করে বলা প্রশ্নে নরম গলায় উত্তর দেওয়া যায় না।
বললাম,
‛ওরা ঢুকতে দিচ্ছিলো না ভেতরে আটটার আগে।’
ঝাঁকি দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
‛রাতে এভাবে একা রেখে চলে গেলা?’
আমি কি উত্তর দিবো। সত্যটাই বললাম, তবে একটু কর্কশ গলায়।
‛আমি কি করবো? রাতে এখানে পুরুষ মানুষ থাকতে দেয় না।’
চিত্রা মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিয়েছে। এটা সহ্য করা যায় না। না বুঝে শুধুই মায়া কান্না কাঁদবে। এখন আর এখানে থাকা যাবে না। চিত্রাকে আরো কষ্ট দিয়ে ফেলবো। রাগ উঠলে এসব মায়া কান্নায় আমার মন গলে না। উল্টো রাগ বাড়ে। শুধু আজ না। চিরকাল আমি এমনই ছিলাম!
বাসায় সকালে নাস্তা তৈরি হতো না। চিত্রা ঘুম থেকে উঠে দেরিতে। রুপম বাবু নিজেই চা করে টোস্ট ভিজিয়ে খেয়ে বেরিয়ে পড়েন। আমার খাবার একই। সেজন্য কষ্ট করতে হয় না। রুপম বাবুই বেশি করে চা বানান। চিত্রা দুপুরে রান্না করে। সপ্তাহে চার দিন আমার ক্লাস থাকে। বাকি দিনগুলোতে চিত্রার সাথে রান্নাঘরে থাকি। পেঁয়াজ মরিচ কেটে দেই। চিত্রা ছোটবেলার গল্প বলে। গল্পের ফাঁকে কখনো তরকারিতে লবন কম বেশি দিয়ে ফেলে। তাতে ঝামেলা তেমন একটা হয় না। রান্না যেমনই হোক, রুপম বাবু খাবার টেবিলে একটা কথাও বলেন না। আমি বলি। সব কাজেই প্রশংসা পাওয়ার মতো অদ্ভুত এক ক্ষমতা নিয়ে রূপবতী মেয়েরা জন্মায়। সেজন্য স্বাদ যেমনই হোক, রূপবতী মেয়েদের রান্নার প্রশংসা না করে পারা যায় না। বলি,
‛তুমি যা রান্না করো না চিত্রা, কি আর বলবো। কোথায় শিখলে বলোতো এতো সুন্দর রান্না?’
চিত্রা বিরক্তি দেখায়। বলে,
‛পাম মারবা না তো, চুপচাপ খাও।’
আমি একদম চুপচাপ খেতে পারি না। চিত্রার তথাকথিত পাম মারা ছাড়াও আরো অনেক কথা বলি। আমার ছোটবেলার কথা বলি। ছোটবেলায় একবার চরমোনাই মাহফিলে গিয়েছিলাম। বাড়ি থেকে শুধু চিড়া, মুড়ি গুড় ইত্যাদি সব শুকনো খাবার নিয়ে গিয়েছিলাম। তিন দিন ছিলাম সেখানে, এগুলোই খেতাম। শেষের দিন এক লোকের থালায় পটল দিয়ে টেংর মাছের তরকারি দেখলাম। আমারও পটল দিয়ে টেংরা মাছের তরকারি খেতে খুব ইচ্ছে হলো। চরমোনাই থেকে সেদিন বাড়ি ফেরার পর আরো নয় বছর কেটে গেছে, পটল দিয়ে টেংরা মাছের তরকারি খাওয়ার ইচ্ছে পূরণ হয় নি। এই তরকারিটার কথা মনে হলেই আমার মুখ কেমন থমথমে হয়ে যায়। চিত্রা তখন হাসতে চায়। হাসি আটকাতে না পেরে ভাত মুখে কাশতে শুরু করে। আমার গল্প থেমে যায়।
‛এভাবে হাসলে আর কিছু বলবো না যাও।’
চিত্রা পানি খেয়ে নিজেকে শান্ত করে। তবুও ঠোঁটে হাসি লেগে থাকে। বলে,
‛যেভাবে কান্না করে দিতেছো, হাসবো না তো কি করবো বলো?’
আমি গাল ফুলিয়ে অভিমানী কণ্ঠে বলি,
‛আমি কাঁদলে তোমার হাসি পায় বুঝি?’
চিত্রা আবার হাসে। দাঁত চেপে হাসে। বলে,
‛শুনো, তোমার কান্না দেখে আমার একটু ও হাসি পাচ্ছে না। তোমার বাচ্চামি দেখে হাসছি। একটা তরকারির জন্য কেউ এভাবে মন খারাপ করে?’
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াই। মাথাটা একটু ওর দিকে ঝুঁকিয়ে নিয়ে বলি,
‛তাহলে শুনো, তুমিই আমাকে এই তরকারিটা রান্না করে খাওয়াও।’
চিত্রা হাসে। জোরে হাসে। হাসির ঝনঝন শব্দ কানে বাজে। আমার আর মন খারাপ থাকে না, তবুও বাড়তি অভিমান দেখাই। রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেই। তবুও হাসি থামে না। আমার মনে হয় এই হাসি আর না থামুক। চিরকাল এইরকম ঝনঝন শব্দ কানে বাজুক। ভাবতে ভাবতে আমি ঘুমিয়ে যাই। ঘুমের মধ্যে ও চিত্রা হাসে। দাঁত বের করে হাসে। সুন্দর হাসি। কাছে গিয়ে মানুষটাকে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হয়। কেনো এমন হয়?
পরদিন সকালে চিত্রা হাতে বাজারের লিস্ট ধরিয়ে দেয়। লিস্ট পড়তে গিয়ে দেখি সবার উপরে টেংরা মাছ আর পটলের নাম লেখা। চিত্রা মুচকি হাসে। আমারও হাসি পায়। অনেক জোরে হাসি পায়। আমার হাসিও কি চিত্রার কানে বাজে? আমি জানি না।
ওয়্যারড্রোবে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় টাকা রাখা থাকে। রুপম বাবু রেখে দেন। বাজারের টাকা। আমি বাজারের বাইরে অতিরিক্ত চল্লিশ টাকা খরচ করি। চিত্রার জন্য বিশ টাকার বিশ টাকার করে চটপটি আর ফুসকা আনি। বাঙালি মেয়েদের প্রিয় খাবার। কলকাতার মেয়ে হলেও তো চিত্রা বাঙালি। ওর এসব আরো বেশি প্রিয়। আমার ভালো লাগে না। কিসব তেতুলের টক, আমার কাছে বিচ্ছিরি লাগে। আমার কাছে ভালো লাগে ওর খাওয়া দেখতে। সময় নিয়ে বাচ্চাদের মতো খায়। রান্নায় দেরি হয়, ঝামেলা এই। দুপুরের খাবার তৈরি হতে হতে প্রায় বিকেল। পটল দিয়ে টেংরা মাছ। রুপম বাবু চুপচাপ খান। একটা কথা ও বলেন না। আমি খেতে পারি না। পটলের ভেতর এতো বিচি, খুবই বিচ্ছিরি ব্যাপার। নয় বছরে যা খাওয়ার ইচ্ছা পূরণ হয় নি, আজীবন তা অপুরণীয় থাকলেই বোধহয় ভালো হতো। পটলের প্রতি আমার মুগ্ধতা থাকতো। এখন মুগ্ধতা কেটে গেছে। একদম কেটে গেছে। খুব বেশি প্রিয় জিনিসের কাছে যেতে নেই। তাতে রহস্য থাকে না। রহস্য ফুরিয়ে গেলে প্রিয় জিনিসটা আর আগের মতো প্রিয় থাকে না। পটলের তরকারি এখন আর খেতে মন চাইছে না। চিত্রাকে এটা বলা যাবে না। বললে হাসবে আবার। সে হাসিতে ঝনঝন শব্দ হবে। আমি তা ফেলে রেখে ঘর থেকে বেরুতে পারবো না। আমাকে বেরুতে হবে। পাঁচটার মধ্যে রুবিদের বাসায় পৌঁছাতে হবে। নিজে বিবিএর ছাত্র হয়ে ও রুবিকে ফিজিক্স কেমিস্ট্রি পড়াই। ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত সাইন্স নিয়ে পড়েছি, তাতেই ভদ্রমহিলা সাহস করে আমার কাছে মেয়েকে পড়তে দিয়ে দিয়েছেন। রুবি হলিক্রসে পড়ে ক্লাস নাইনে। গার্লস স্কুলের মেয়েদের জন্য কখনো ছেলে হোমটিউটর রাখতে নেই। তাতে বিপদ আছে। বিপদটা আমি জানতাম না। রুবির মা নিজেই আমাকে একদিন জানিয়ে গেছেন। রুবির বান্ধবী মিতু ক্লাস এইটে জেএসসি পরীক্ষার আগে ইন্টারে পড়ুয়া হোম টিউটরের সাথে পালিয়ে গেছে। তিন দিন পর মিতুর খোঁজ মিললো, ওই হোম টিউটরের বাড়ি নওগাঁতে। ঢাকা থেকে পালিয়ে দুজনে নওগাঁয় গিয়ে বিয়ে করেছে। নওগাঁ থেকে মিতুকে পরে ওর বাবা মা ঢাকায় নিয়ে এসেছে। মিতু নাকি পরে স্বীকার করেছে, পরীক্ষায় ভালো প্রস্তুতি ছিলো না বলেই পালিয়ে গেছে। এটা সত্যি নাইন টেনের বয়সে মেয়েদের শরীরে প্রেম আসে। সেজন্য এই বয়সেই মেয়েরা প্রেমিক খুঁজতে থাকে। এই কাজে গার্লস স্কুলের মেয়েদের কষ্ট বেশি। ক্লাসে ছেলে থাকলে প্রেম করতে সুবিধা। এই বয়সের প্রেম অনেক বেশি শরীর চায়। স্কুলে ছেলে থাকলে যখন তখন ছোঁয়া যায়, এই সুবিধা। গার্লস স্কুলে এই সুবিধা নেই। সেজন্য কেউ কেউ হোমটিউটরের প্রেমে পড়ে। আমি এসবে ভয় পাই না, রুবিকে আরো বেশি কাছে টানি। ফিজিক্স কেমিস্ট্রির বাইরেও শ্রদ্ধা, সম্মান ভালোবাসা শিখাই। রুবি আমাকে ভালোবাসে, কিন্তু শিক্ষক হিসেবে। পড়ানো শেষ হলে রুবি আমাকে ওর বেলকুনিতে নিয়ে যায়। গাছের টবে পানি দেয়। আমিও সাথে দেই। ছাদে নিয়ে রুবি আমার হাত ধরে আকাশ দেখে। সে স্পর্শে কামনা থাকে না, সম্মান থাকে। আমার শেখানো সম্মান!
বাসায় গিয়ে তবুও চিত্রাকে রুবির বান্ধবী মিতুর গল্প বলি। রুবির সাথে ওর টবে পানি দেওয়ার গল্প বলি।
রোজ ছাত্রী শিক্ষকের একসাথে আনন্দময় মুহূর্তগুলো সব এসে বলি। চিত্রা শুনে। মিতুর গল্প বলার পর থেকে চিত্রা চুপ করে শুনে। কোনো কথা বলে না, বিরক্তির চোখে আমাকে দেখে। একদিন সন্ধ্যায় রুবির ছাদে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দুজনে সন্ধ্যা তাঁরা গুনার গল্প বলি। চিত্রা মুখে কিছু বলে না। খুব শক্ত করে আমার হাত ধরে। হাত ছাড়ে না, টেনে টেনে ছাদে নিয়ে যায়। ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে বসায়। নিজেও বসে। সন্ধ্যা তাঁরা গুনার ইচ্ছে পূরণ হয় না, রাতের তারা গুনে। হাতটা কাছে টেনে নিয়ে খুব অভিমানী কণ্ঠে বলে,
‛মিহির তুমি আর রুবিকে পড়াতে যাবা না।’
এরকম কিছু শুনতে অপ্রস্তুত ছিলাম। রেলিংয়ে হেলান ছেড়ে চিত্রার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলি,
‛এটা কি বলছো? পড়াতে যাবো না?’
চিত্রা আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ঘাড় নাড়াতে নাড়াতে বলে,
‛না যাবা না।’
আমি ব্রু কুঁচকাই। একটু শব্দ করেই জানতে চাই।
‛কেনো?’
চিত্রা আমার হাত ছেড়ে দাঁড়িয়ে সশব্দে চেঁচিয়ে উঠে,
‛যাবা না মানে যাবা না। আমি বলছি তাই যাবা না।’
বলেই ছাদ ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি, সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামতে থাকা চিত্রার জুতোর শব্দ আমার কানে আসে। কি অসম্ভব ধরণের রাগ, তবে একদম অকারণে। কিছু না বুঝে এভাবে রাগ করার কোনো মানে হয় না। মিতু আর ওর হোম টিউটরের মধ্যে যেই জিনিসটার অভাব ছিলো, সেটা শ্রদ্ধা আর সম্মান। আমি এসব রুবিকে আগেই শিখিয়ে নিয়েছি। মিতুর সাথে যেমনটা হয়েছে, রুবির সাথে তেমনটা হবার নয়। চিত্রা এটা বুঝতে চাইবে না। রাগ করবে, অভিমান করবে, গাল ফুলিয়ে থাকবে। তাতে আমার রাগ আরো বাড়ে। আমি ছাদেই দাঁড়িয়ে থাকি, নিচে যাই না। আমার রাগ তবুও দ্রুতই ভেঙে যায়, কিন্তু চিত্রার অভিমান ভাঙে না। রাগ আর অভিমান একই জিনিস না। রাগ নিজে থেকেই ভাঙে, কিন্তু অভিমান ভাঙে না। ভাঙাতে হয়। সেজন্য অভিমান মেয়েদেরকেই মানায়, ছেলেদেরকে না। নিজের ব্যক্তিত্বের খোলস থেকে বেড়িয়ে এসে, কি ভীষণ জেদ অহংকার সব ধুলোয় মিশিয়ে, একটা শিশুসুলভ ব্যাক্তিত্ব নিয়ে, প্রিয়জনের সামনে দাঁড়িয়ে অভিমান ভাঙানোর ক্ষমতা একমাত্র পুরুষই রাখে। আমিও রাখি, সেকথা চিত্রা জানে!
রোজ ছাত্রী শিক্ষকের একসাথে আনন্দময় মুহূর্তগুলো সব এসে বলি। চিত্রা শুনে। মিতুর গল্প বলার পর থেকে চিত্রা চুপ করে শুনে। কোনো কথা বলে না, বিরক্তির চোখে আমাকে দেখে। একদিন সন্ধ্যায় রুবির ছাদে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দুজনে সন্ধ্যা তাঁরা গুনার গল্প বলি। চিত্রা মুখে কিছু বলে না। খুব শক্ত করে আমার হাত ধরে। হাত ছাড়ে না, টেনে টেনে ছাদে নিয়ে যায়। ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে বসায়। নিজেও বসে। সন্ধ্যা তাঁরা গুনার ইচ্ছে পূরণ হয় না, রাতের তারা গুনে। হাতটা কাছে টেনে নিয়ে খুব অভিমানী কণ্ঠে বলে,
‛মিহির তুমি আর রুবিকে পড়াতে যাবা না।’
এরকম কিছু শুনতে অপ্রস্তুত ছিলাম। রেলিংয়ে হেলান ছেড়ে চিত্রার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলি,
‛এটা কি বলছো? পড়াতে যাবো না?’
চিত্রা আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ঘাড় নাড়াতে নাড়াতে বলে,
‛না যাবা না।’
আমি ব্রু কুঁচকাই। একটু শব্দ করেই জানতে চাই।
‛কেনো?’
চিত্রা আমার হাত ছেড়ে দাঁড়িয়ে সশব্দে চেঁচিয়ে উঠে,
‛যাবা না মানে যাবা না। আমি বলছি তাই যাবা না।’
বলেই ছাদ ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি, সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামতে থাকা চিত্রার জুতোর শব্দ আমার কানে আসে। কি অসম্ভব ধরণের রাগ, তবে একদম অকারণে। কিছু না বুঝে এভাবে রাগ করার কোনো মানে হয় না। মিতু আর ওর হোম টিউটরের মধ্যে যেই জিনিসটার অভাব ছিলো, সেটা শ্রদ্ধা আর সম্মান। আমি এসব রুবিকে আগেই শিখিয়ে নিয়েছি। মিতুর সাথে যেমনটা হয়েছে, রুবির সাথে তেমনটা হবার নয়। চিত্রা এটা বুঝতে চাইবে না। রাগ করবে, অভিমান করবে, গাল ফুলিয়ে থাকবে। তাতে আমার রাগ আরো বাড়ে। আমি ছাদেই দাঁড়িয়ে থাকি, নিচে যাই না। আমার রাগ তবুও দ্রুতই ভেঙে যায়, কিন্তু চিত্রার অভিমান ভাঙে না। রাগ আর অভিমান একই জিনিস না। রাগ নিজে থেকেই ভাঙে, কিন্তু অভিমান ভাঙে না। ভাঙাতে হয়। সেজন্য অভিমান মেয়েদেরকেই মানায়, ছেলেদেরকে না। নিজের ব্যক্তিত্বের খোলস থেকে বেড়িয়ে এসে, কি ভীষণ জেদ অহংকার সব ধুলোয় মিশিয়ে, একটা শিশুসুলভ ব্যাক্তিত্ব নিয়ে, প্রিয়জনের সামনে দাঁড়িয়ে অভিমান ভাঙানোর ক্ষমতা একমাত্র পুরুষই রাখে। আমিও রাখি, সেকথা চিত্রা জানে!
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন