সঙ্গোপনে ৩

সন্ধ্যার পর হাসপাতালে অসাধু লোকের আনাগোনা বেড়ে যায়। ভদ্র লোকের লেবাস লাগিয়ে কিছু দালাল ঘোরাফেরা করে। সবচেয়ে বেশি ধান্দা হয় আইনি জটিলতা বিষয়ক রোগীকে ঘিরে। আত্মহত্যা করা কোনো রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হলে, সাথে সাথে একটা মামলা হয়। রোগী কোনো কারণে মারা গেলে আত্মহত্যার কারণ খুঁটিয়ে দেখতে হাসপাতালে লাশ পোস্টমর্টেম করা হয়। থানা থেকে ছাড়পত্র দিলে তবেই লাশ নিয়ে বাড়ি ফেরা যায়। অনেকেই থানা পুলিশ করতে ভয় পায়। তাই রোগীকে ঘিরে যতো ঝামেলা থাকে, তা পারিবারিক ভাবেই মিটিয়ে ফেলতে পছন্দ করে। তাই আত্মহত্যা করা রোগী কেউ মারা গেলে পরিবারের লোকজন গিয়ে দালালদের শরণাপন্ন হয়। দালালদের সাথে পুলিশের যোগসূত্র আছে। ধান্দা করা টাকা অল্প কিছু দালালরা পায়, বেশিরভাগটাই পুলিশের পকেটে যায়। মূলকাজটাও পুলিশই করে। পুলিশ তদন্ত রিপোর্ট দিয়ে দিলেই হাসপাতাল থেকে লাশ ছেড়ে দেওয়া হয়। একটু বেশি টাকা দিলে, পোস্টমর্টেম ছাড়াই লাশ হাতে পাওয়া যায়। এরকমটা প্রতিনিয়তই হচ্ছে এখানে। এই হাসপাতাল ঘিরে যতো মামলা সব শাহবাগ থানাতেই হয়। শাহবাগ থানার একজন ইন্সপেক্টর এসেছে হাসপাতালে রাতের ডিউটিতে।
তাকে ঘিরেই একটু ভিড়ের মতো হয়েছে ইমার্জেন্সি গেটের সামনে। কি হচ্ছে দেখার আগ্রহ নিয়ে সামনে গেলাম। পুলিশের টাকা নেওয়ার ব্যাপারটা বেশ হাস্যকর। কেউ হাতে দিলে মুঠোবন্ধি অবস্থায়ই তাড়াতাড়ি সেটা পকেটে রাখছে। যেনো কেউ দেখছেই না টাকা নেওয়ার ব্যাপারটা। কাঁক চোখ বন্ধ করে সাবান লুকায়, ভাবে কেউ দেখে না। কিন্তু লুকানো সাবানটা কাঁক নিজেই আর খুঁজে পায় না। কাঁক বোকা হতে পারে, কিন্তু পুলিশ বোকা না।
‛দেখেন ভাই রাত জেগে কতো কষ্ট করে আপনাদের জন্য ডিউটি করি। আপনাদের উপকার করি। কতো দ্রুত লাশ বের করে দেই। কিন্তু আপনারা তো ভাই এই উপকার মনে রাখেন না। যাওয়ার সময় পারেন না, টাকা না দিয়েই চলে যান।’
জীপের সামনে রেখে ক্লিপবোর্ডে আটকানো একটা খাতার পাতায় কি যেনো লিখছে, আর কথা গুলো বললো ইন্সপেক্টর। পাশ থেকে একজন বললো,
‛হ, ভাই। এই দুই হাজার টাকা তো থানাতই লাগবো। স্যারেরে দুই একশো টাকা বাড়াইয়া দিয়া যাইয়েন। চা পানি খাইবো। কতো কষ্ট করতাছে দেখছেন?’
এই লোকটা সম্ভবত দালাল হতে পারে। পুলিশ কাজ করে, দালালরা দরদাম ঠিক করে। এখানে দরদাম আগে থেকেই ঠিক করা। এখন ক্লায়েন্টের মন জয় করে অতিরিক্ত আরো দুই একশো টাকা নিতে পারলেও খারাপ কি। দালাল লোকটা সেই চেষ্টাই করছে হয়তো।
ইন্সপেক্টরের এতক্ষন ধরে লেখা খাতার পৃষ্টাটা নিয়ে যাওয়ার সময় বুড়ো করে লোকটা ঠিকই দুইটা একশো টাকার নোট হাতে গুঁজে দিয়ে বললো,
‛আপনার উপকার আমি মনে রাখমু স্যার। কি যে হইতো আপনে না থাকলে। আমার মরা মাইয়ার শইলডা টুকরো টুকরো কইরা কাটতো। কতো কষ্ট পাইতে পাইতে মরছে মাইয়াডা আমার। অহন কবরে তো একটু শান্তিতে ঘুমাইতে পারবো।’
চোখ মুছতে গিয়ে ভুল করে চোখের জলে কাগজই খানিকটা ভিজিয়ে ফেললো ভদ্রলোক।

একজন যেতে না যেতেই অনেকজন সামনে এগিয়ে আসলো। একজন বলছে,
‛স্যার দোহাই লাগে, আমারটা আগে কইরা দেন। বাড়ি মেলা দূরে। গ্রামে সকাল বেলা জানাযা বইলা রাখছি। রাত্রের মধ্যে লাশ নিয়া বাড়ি ফিরতে না পারলে কেলেঙ্কারি হইয়া যাইবো।’
পুলিশ অফিসার একে একে সবার কাজই করে দিচ্ছে।  মহান মানুষ উনি। বিনিময়ে শুধু কিছু টাকা নিচ্ছে! তা আর এমন কি। যারা টাকা দিচ্ছে, খুশিমনেই দিচ্ছে। যার কাছে টাকা নেই, সে শুধু দাঁড়িয়ে কাঁদছে। লাশ মর্গে পড়ে আছে, বের করতে পারছে না। মরার উপর কাটার আঘাত যাকে বলে।
আমার তেমন কিছুই করার নেই, দাঁড়িয়ে এসব গল্প শোনা ছাড়া।
শফিকুল্লা আসছে ওর মাকে নিয়ে। একদম মরা লাশ হাসপাতালে ঢুকিয়েছে। স্ট্রোক করেছিলো। হাসপাতালে আনতে আনতে পথেই মারা গেছে। শফিকুল্লা বুঝতে পারে নি। ভেবেছিলো হাসপাতালে নিলেই মা সুস্থ হয়ে যাবে। সুস্থ হয়ে দুদিন পর মা আবার খুব সকালে ভাত রেঁধে ছেলেকে খাইয়ে দিবে। ছেলে সারাদিন রিক্সা চালিয়ে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরবে। মায়ের পাশের বালিশে ঘুমিয়ে সারাদিনের ক্লান্তি মুছবে।
হাসপাতালে পৌঁছে সফিকুল্লার আশা ভঙ্গ হয়। ডাক্তার রোগীকে মৃত ঘোষণা করে। তার আগে একটা ঘটনা ঘটে গেছে। সফিকুল্লার মাকে হাসপাতালে ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে ভর্তি করানো হয়ে গেছে। হাসপাতাল যেহেতু রোগীকে জীবিত পায় নি, সেজন্য স্বাভাবিকভাবেই একটা মামলা হয়ে গেছে। এখন পুলিশ ছাড়পত্র দিলেই হাসপাতাল থেকে লাশ ছেড়ে দিবে।
কিন্তু ইন্সপেক্টর সাহেব বরাবরের মতোই মহান মানুষ। উনি সফিকুল্লার বুড়ো মায়ের লাশটা পোস্টমর্টেম করবে। মৃত্যুর কারণ খুঁটিয়ে দেখবে। ষড়যন্ত্র করেও তো কেউ সফিকুল্লার মাকে মেরে ফেলতে পারে। যেহেতু হাসপাতাল রোগীকে মৃত পেয়েছে। এ নিয়ে থানায় কতোদিন মামলাও চলবে।
শফিকুল্লা মিনতি করছে ইন্সপেক্টরের সামনে দাঁড়িয়ে।
‛দয়া করেন স্যার, আমার মা মর্গে পইড়া আছে। কষ্ট পাইতাছে। সারাজীবন সুখ দিতে পারি নাই। কবরে মারে একটু শান্তিতে শোয়াইতে দেন স্যার, দয়া করেন।’
আমার সাথে মায়ের মৃত্যুর গল্প বলেই ইন্সপেক্টরের সামনে গিয়েছিলো ছাড়পত্রের জন্য।
এই ইন্সপেক্টরের সামনে দাঁড়িয়ে শুধু কাঁদলে কিছু হবে না। এটা সফিকুল্লা জানে না। আমি জানি। আমি অনেক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে দেখছি এখানকার সব কর্মকান্ড। ইন্সপেক্টর সফিকুল্লার কথা কানেই নিচ্ছে না। ক্লিপবোর্ডে অন্য কারো জন্য ছাড়পত্র লিখছে।
আমি আস্তে করে আবার ডাক দিলাম,
‛ভাই টাকা পয়সা ছাড়া এই লাশ মর্গ থেকে বের করতে পারবেন বলে মনে হয় না। যা দেখতেছি, সবই তো টাকার খেলা।’
আমি দালাল টাইপের কেউ না, সেটা শফিকুল্লা বুঝতে পেরেছে।
‛টাকা পয়সা আর কই পামু ভাই। মারে অ্যাম্বুলেন্স দিয়া হাসপাতালে আনছি। যা আছিলো, ভাড়া দিয়া দিছি। গোছগাছ করলে এক হাজারের বেশি হইবো না আর।’
বলেই লুঙ্গির গিট্টু থেকে একটা পাঁচশো টাকার নোট আর কিছু খুচরো টাকা বের করলো। খুচরো টাকা কম না। সব মিলিয়ে এগারোশো সত্তর টাকা হলো। সফিকুল্লার হাতে একশো সত্তর টাকা দিয়ে বাকি এক হাজার টাকা পুলিশ ইন্সপেক্টরকে সাধলাম। আমার হাতটা ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিলো। বললো,
‛এক হাজারে কিভাবে হয় ভাই? দেখেন না কতো করে নিতেছি?’
আবার ধরলাম হাতটা। টাকাটা মুঠের মধ্যে চেপে দিয়ে বললাম,
‛গরিব মানুষ স্যার। লাশটা দিয়ে দেন।’
টাকাটা আবার আমার হাতে দিয়ে দিলো। বললো,
‛ঠিকআছে আর পাঁচশো দেন।’
সফিকুল্লার দিকে তাকালাম। অসহায় মুখভঙ্গি। আমি পকেট থেকে একটা চকচকে পাঁচশো টাকার নোট বের করলাম। চিত্রার জমানো টাকা। নিজের হাতে খরচ করতে নিশ্চয় ওর খুব মায়া লাগতো। আমার লাগছে না। আমার শুধু চিন্তা হচ্ছে, বাকি একশো সত্তর টাকায় সফিকুল্লার মায়ের দাফন হবে?
রাতে হাসপাতালের এক নম্বর গেট বন্ধ। ইমারজেন্সি গেট দিয়েই আসা যাওয়া করা লাগে। ভালো লাগে না। মুমূর্ষু রোগীদের এই গেট দিয়ে ঢুকানো হয়। বের করা হয় বেশিরভাগ মরা মানুষ। গেটের সামনে সারি সারি অ্যাম্বুলেন্স। গেট দিয়ে ঢুকতে একটু সামনেই মর্গ। মৃত মানুষ দেখতে আর ভালো লাগে না। রাত কাটাতে হবে হাসপাতালের এরিয়ার ভেতরেই। সারাদিন কেটে গেলো হাসপাতালে, তাও পুরোটা ঘুরে দেখা হয় নি। ইচ্ছেও করছে না। অন্যসময় বিকেলে ঘুমালে রাতে ঠিকঠাক ঘুম আসতে চাইতো না। আজকে ব্যপারটা উল্টো। বিকেলে ঘুমিয়েছি, এখন আরো বেশি ঘুম পাচ্ছে। বিকেলে ঘুম ঠিকঠাক হয় নি। বাজে একটা স্বপ্নে কেটে গেছে। এখন একটু বসার জায়গা পেলেই হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। অন্যান্য সাধারণ ওয়ার্ডগুলোর সামনে পুরুষের থাকতে সমস্যা নেই। পুরুষের অভাবও নেই। যে যেভাবে পারছে, মাদুর পেতে ঘুমোচ্ছে। বারান্দা জুড়ে ঘুমন্ত মানুষের ভিড়ে কেউ কেউ জেগে কাঁদছে! হাসপাতাল বলেই হয়তো এরকম। কান্না মুছতেই মানুষ হাসপাতালে আসে। প্রিয়জনকে সুস্থ করতে আসে। তবে হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার পথে সবার মুখে হাসি ফোটে না। প্রিয়জন হারিয়ে কেউ কেউ কান্না রেজিস্ট্রি করে হাসপাতাল থেকে বের হয়। যা কোনোদিনও মুছে না!

চিত্রার ওয়ার্ড বরাবর দোতলা থেকে একতলায় নামার সিঁড়ি। সিঁড়ির দুপাশে ফাঁকা জায়গাগুলো বসার চেয়ার আছে। কিন্তু ফাঁকা নেই। একজন উঠতেই অন্যজন বসে পড়ে। হাসপাতালে বসার জায়গার খুব অভাব। অভাব নেই মানুষেরও। রোগীর সাথে অনেকেই হাসপাতালে চলে আসে। প্রিয় কাউকে হাসপাতালের বেডে শুইয়ে রেখে বাড়িতে আরাম করে ঘুমানো যায় না হয়তো। রোগীর সাথে প্রয়োজনে আসে দুয়েকজন। বাকিরা অপ্রয়োজনে আসে। হাসপাতালে এসে ভাসমান সংসার বানায়। রাত বাড়লে হুশ থাকে না। হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমায়। আমার ঘুম পাচ্ছে। পুরো শরীর ব্যাথা হয়ে আছে। হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়েই ঘুমোতে ইচ্ছে করছে। সে সুযোগ নেই। যে জায়গাতে শুয়েছি, সেখানে কোনোরকম নড়াচড়াই বিপদজনক।
সিঁড়ির দুপাশে একটু উঁচু মোটা দেয়াল আছে। এক পাশে দেয়ালের মাথায় এক লোক বসা আছে দেখে অপরপাশে আমি বসেছিলাম। বসে থাকতে পারি না। চোখে ঘুম। যেভাবে বসেছিলাম, সেভাবেই দেয়াল বরাবর শুয়ে পড়লাম। ক্লান্ত শরীরে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেই চোখে ঘুম চলে আসে। এটা বিছানা না। কংক্রিটের দেয়াল। তবুও বিছানা মনে হচ্ছে। খারাপ না। একবার ঘুমিয়ে গেলে সারারাতেও আর ঘুম ভাঙবে না। কিন্তু চিত্রার ঘুম ভাঙবে। একটু পরই ঘুম ভেঙে যাবে। উঠে একটু পাশ ফিরতেই দেখবে, বেডে বিপরীত পাশে মহিলাটা ঘুমাচ্ছে। হয়তো একটু পর পর নাক ডাকছে। কি বিশ্রী অবস্থা হবে। সারারাতে আর একটুও ঘুমাবে না। খুব করে চাইবে বেডের ঐটুকু জায়গাতে ঐ মহিলাটা না থাকুক। তবে কেউ একজন থাকুক। যাকে পাশ ফিরে জড়িয়ে ধরা যাবে। দু গালে চুমু খাওয়া যাবে। মানুষটার আদর পেতে পেতে আবার ঘুমিয়ে পড়া যাবে! সে ঘুমে একটা সুন্দর প্রেমের ছবি আঁকা হবে।

রুপম বাবু বাসায় যতক্ষণ থাকতেন, ঘুম নাহয় ছবি, এই দুটো জিনিস নিয়েই পড়ে থাকতেন। চিত্রা তখন আমাকে ছাড়তো না। গল্প করবে, নয়তো শোকেস থেকে নিজের প্রিয় জিনিসগুলো বের করে দেখাতে থাকবে। শোকেসে সাজানো ছিলো উপরে একটা পুতুল। নামিয়ে আমার হাতে দেয়। বলে,
‛এটার নাম আছে। জানবে?’
‛পুতুলের আবার নাম হয় নাকি?’
‛হ্যাঁ, হয় তো। এটার একটা সুন্দর নাম আছে। মিনা দিয়েছে।’
চিত্রা আগ্রহ নিয়ে বলে কথাটা। আমি আগ্রহ আরেকটু বাড়িয়ে দেই। বলি,
‛তুমি বলেছিলে নাকি মিনাকে নাম ঠিক করে দিতে?’
“আরে না। মিনা আর্ট কলেজে আমার বান্ধবী ছিলো। আমার জন্মদিনে কি করলো শুনো। এই পুতুলটা হাতে দিয়ে বললো, ‛নে, তোর জন্য সুহাসিনী কে নিয়ে আসলাম।’ আমি তো অবাক। বললাম, ‛পুতুলের নাম সুহাসিনী?’ মিনা হাসলো। বললো, ‛দেখছিস না কেমন হাঁসি ঠোঁটে? অলটাইম হাসবে। তোর মন খারাপ থাকলে এটা সামনে রাখবি, দেখবি হাসছে।’ তারপর থেকে এটার নাম সুহাসিনী। দেখো হাসছে না কেমন?”
দেখি, সত্যিই পুতুলটার ঠোঁটে হাসি। এটার মুখের গড়ন বানানোই হয়েছে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে। তাই তাকালেই মনে হয় হাসছে। সে হাসি চিত্রার মুখেও ছড়িয়ে পড়ে। পুতুলটার দিকে তাকিয়ে আবার চিত্রার দিকে তাকাই। বলি,
‛তুমিও তো সুহাসিনী। খুব সুন্দর করে হাসো।’
‛সুন্দর করে হাসি হ্যাঁ?’
‛হ্যাঁ, সুন্দর করে হাসো।’
‛তুমি এমন করে তাকিয়ে থাকো, তাইতো এতো হাসি পায়।’ বলেই চিত্রা মুখ টিপে হাসতে শুরু করে। আমার লজ্জা লাগে। আমি সত্যিই মনে হয় অনেক বেশি তাকিয়ে থাকি চিত্রার দিকে। এটা প্রেমে পড়ার প্রভাব হয়তো। মেয়েরা খুব ভালো বুঝতে পারে এই ব্যাপারগুলো। সংকোচ কাটাতে চিত্রাই সামনে আসে। বলে,
‛আরে বাবা মুখটা এমন করে কি ভাবছো? তাকাতে নিষেধ করছি আমি?’
পুতুলটা আচমকা চিত্রার হাতে দিয়ে বলি,
‛না। কিন্তু আমিই আর তাকাবো না।’
বের হয়ে আসি ঘর ছেড়ে। চিত্রা তখন শব্দ করে হাসে। হটাৎ মনে হয়, হাসিটা যেনো খুব তাড়াতাড়ি বন্ধ না হয়। ভালো লাগে শুনতে।

রুপম বাবুর ছবি আঁকা নিয়ে আমারই আগ্রহ ছিলো অনেক বেশি। ছবি আঁকতে সাহায্য করি। ক্যানভাস রেডি করে দেই। কাঠের ফ্রেমে টান টান করে ক্যানভাস কাপড় তারকাঁটা দিয়ে আটকানো লাগে। মাঝে মাঝে তারকাঁটা মিস করে হাতুড়ির আঘাত হাতের আঙ্গুল  গিয়ে লাগে। রুপম বাবু নিষেধ করেন। তবুও করি। আগ্রহ নিয়ে করি। আঁকার সময় পাশে বসে থাকি। রঙ গুলিয়ে দেওয়ার কাজটাও করি। রুপম বাবুকে আঁকতে দেখে আমারও ইচ্ছে হয় আঁকতে। আঁকবো, সাহস করে বলা হয় হয়না। কি আঁকতে কি এঁকে ফেলি! আমার নিজের শৈশব আঁকতে ইচ্ছে হয়। গ্যারেজে রিক্সার, সাইকেলের পরিত্যাক্ত টায়ার পাঁচ টাকায় বিক্রি করে দিতো। কিনে আনতাম। বড় সড়কে টায়ার চালাতে নেমে পড়তাম। একটা লাঠিই টায়ারের কন্ট্রোলার। খালি গায়েই টায়ার চালাতে চালাতে কতোদূর চলে যেতাম। কখনো রোদ, কখনো বৃষ্টি। বাড়ি এসে কাজ ফাঁকি দিয়ে টায়ার চালানোর অপরাধে মারও খেতাম।
মার খেয়ে কাঁদি নি কখনো। কিন্তু টায়ারটা পুড়িয়ে দিলে সে কি কান্না। আসলে কষ্ট লাগতো খুব। নতুন করে পাঁচ টাকা জমাতে সময় লেগে যাবে। ততদিন বন্ধুদের সাথে সড়কে রেস খেলা হবে না। একটা রেস ছিলো; উঁচু ব্রিজ থেকে টায়ার ছেড়ে দিলে, সোজা কারটা কতোটুকু যায়। যারটা বেশি যাবে, সে বিজয়ী। টায়ার চালিয়েই মনে হতো গাড়ি চালাচ্ছি। ভীষণ মজা লাগতো। কয়দিন পর আরেকটা বিলাসবহুল গাড়ি নামলো। বিয়ারিং গাড়ি। সাইকেলের বিয়ারিং দিয়ে চাকার মতো বানিয়ে এক ধরণের কাঠের গাড়ি নামলো। একজন গাড়িতে স্টিয়ারিং ধরে বসে থাকে, অন্যজন পেছন থেকে ধাক্কা দিতে থাকে। অন্যকে ধাক্কা দিতে দিতে সারাদিন ঘামে ভিজতে থাকতাম। সামান্য একটু সময়ের জন্য গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে বসতে পারতাম। কি যে ভালো লাগতো। বিমান আকাশে উড়ে আমি জানতাম, তবুও মনে হতো বিমান চালাচ্ছি। ইশ যদি ব্যাক্তিগত একটা বিমান থাকতো। খরচ অনেক। লোহা আর বিয়ারিং দিয়ে স্টিয়ারিং বানাতেই লাগবে পঞ্চাশ টাকা। পেছনের চাকার জন্য আরো দুইটা বিয়ারিং চল্লিশ টাকা। কাঠ, লাঠি আছে, কিন্তু তারকাঁটা তো লাগবে। আরো পাঁচ টাকা। ছয়মাস পর পাইসা বিলে শাপলা ফোটে। তখন একটাকা দরে প্রতি মোটা শাপলা বিক্রি করে করে পঁচানব্বই টাকা জমানো হয়। ততোদিনে রাস্তায় আর কেউ বিয়ারিং গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে বসে থাকে না। সমবয়সীরা সাইকেল নিয়ে নেমেছে। হিরো সাইকেল। চারহাজার টাকা দাম। পাইসা বিলে এতো মোটা শাপলা নেই! আমি আবার সাইকেলের টায়ার নিয়েই রাস্তায় নামি। এটাই আমার গাড়ি। বিলাসবহুল কোনো গাড়ি। খালি গায়ে রোদ্রে পুড়তে পুড়তে সেই বিলাসবহুল গাড়ি চালানোর দৃশ্যটি ক্যানভাসে আঁকতে ইচ্ছে হয়। রুপম বাবুকে বলি এসব ইচ্ছের কথা। রুপম বাবু তখন আমার শৈশব ক্যানভাসে আঁকতে শুরু করেন। আমি আগ্রহ নিয়ে বসে বসে শৈশবের গল্প বলি।
চিত্রার হিংসে হয়। আমি ওর বন্ধু। অথচ, রুপম বাবুর সাথে বেশি মিশে গেছি। বকা দেয়।
‛বান্দর একটা। কবিতা ছেড়ে সে এখন ছবি আঁকা দেখে। শিল্পী  নাকি হবে, এহহ।’
রুপম বাবু হাসেন। বলেন,
‛যাও তোমার বন্ধুর কাছে। দেখো গিয়ে, একা ভালো লাগছে না হয়তো।’
চিত্রাকে শুনিয়েই বলি,
‛না, ছবি শেষ না হতে আমি যাবো না।’
সঙ্গ পাবার জন্য চিত্রা তখন লোভনীয় অফার দেয়। ছাদে নিয়ে যাবে। এরকম অফার মিস করা যায় না। বসে থাকতে থাকতে পা ব্যাথা করছে বলে ইজেলের সামনে থেকে উঠে আসি। চিত্রার পিছু পিছু ছাদে চলে আসি। একা ছাদে আসতে পারি না। বাড়িওয়ালার কাছে ছাদের চাবি। চিত্রাকে দেয়। আমি চাইলে দেয় না। চিত্রার সাথে ছাদে আসার লোভ আমি কখনোই সামলাতে পারি না। চিত্রা ছাদে আসার কথা বললেই, রুপম বাবুকে ফাঁকি দিয়ে চলে আসি। মাথার উপরে বিশাল আকাশ দেখি। শহর দেখি। শহরের প্রকৃতি দেখি। শহরের বসন্ত আলাদা। গ্রামের মতো একদমই না। গাছপালা কম। শিমুল ফুলের দেখা না মেললে, বসন্ত এসেছে বলে আমার মনে হয় না। কোকিল নেই, শিমুল ফুল নেই, তবুও ঋতুরাজ বলে কথা। ফাল্গুনী হওয়া সম্পূর্ণ আলাদা। শরীরে লাগলে বসন্তের আগমন টের পাওয়া যায়। চিত্রা টেনে ছাদের কিনারে নিয়ে যায়। সুন্দর বাতাস খারাপ লাগে না। আশেপাশের লোকজন কেমন করে তাকায়। তার কারণ আছে। চিত্রা শাড়ি পড়ে ছাদে উঠেছে। গাঢ় সবুজ পাড়ের হালকা হলুদ রঙের শাড়ি। পহেলা ফাল্গুন, আমি আগে জানতাম না। সাদা টিশার্ট গায়ে দিয়েছি। লোকে কেমন ভাবছে। নিশ্চয় প্রেমিক প্রেমিকা ভাবছে! চিত্রার বয়স বেশি না। শাড়িতে আরো বেশি পিচ্চি লাগে। লোকের তাই এমনটা মনে করাও অপরাধ না। ছাদের কিনারে গিয়ে আমি ভয় পাই না।  চিত্রা ভয় পায়। আমার হাত ধরে। বলে,
‛আকাশ দেখা হলো?’
চিত্রার দিকে তাকাই। বলি,
‛কই আকাশ দেখছি না তো।’
‛ডং। কি দেখছো তাহলে?’
‛আকাশের মতো করে তোমাকে দেখছি।’
‛আমাকে দেখছো না ছাই। ভালো করে তাকালেও না একবার। ভাবলাম; সত্যিই বোধহয় রাগ করছো, আর তাকাবে না।’
‛উহু, রাগ চলে গেছে। জানো, আকাশের দিকে তাকিয়েই তোমাকে দেখলাম।’
‛আমাকে? কিভাবে দেখলে?’
‛আকাশের দিকে তাকিয়েও আকাশের কথা ভুলে গেলাম। তোমায় সামনে রেখেও কল্পনায় দেখলাম।’
‛আকাশে তাকিয়েই আকাশ ভুলে গেলে? বাবা!’
‛হু কি করবো বলো? তুমিই বেশি সুন্দর তাই আকাশ নিয়ে ভাবতে পারলাম না।’
লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া চিত্রা মুখোমুখি দাঁড়ায়। আবদারের সুরে বলে,
‛আকাশ রাখো। বসন্তের কবিতা শুনাবা না?’
আমার মাথায় তেমন কোনো কবিতা আসে না। দুটো লাইন আসে। চিত্রার চোখে তাকিয়ে বলি,
‛ফাল্গুনী বাতাসে মুছুক হৃদয়ে শূন্যতার হাহাকার,
মুছে যাক এই বসন্তে দূরত্ব তোমার আমার।’
শেষ না করতেই চিত্রা হাত ধরে কাছে টান মারে। একদম কাছে। নিঃশ্বাসের শব্দ পাওয়া যায় এতোটা কাছ থেকে, চোখে চোখ রেখে, প্রেম মেশানো কন্ঠে বলে,
‛দূরত্ব আছে নাকি?’
আমি থতমত খেয়ে যাই। শিরা উপশিরা বেয়ে মস্তিকে রক্ত উঠতে থাকে। সমস্ত শরীর কাঁপতে থাকে। চিত্রার গোলাপি ঠোঁটযুগল আমায় কাছে টানতে থাকে। এমন কেনো হলো?

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

এখনো ভালোবাসি তোমায়

বলতে পারিনি "ভালোবাসি"!

একটি প্রত্যাখানের গল্প: "তবুও ভালোবাসি"