সঙ্গোপনে ১
সরকারি হাসপাতালে আগে আসা হয় নি। একদম হ জ ব র ল অবস্থা। রোগীর তুলনায় শয্যার সংখ্যা কম। এক শয্যায় দুইজন রোগী আগে কখনো চোখে পড়ে নি আমার। চিত্রার পাশে একজন অর্ধবয়স্ক মহিলার হাতে স্যালাইন চলছে। একজনের বেডে দুজন শুয়ে থাকা, আমার নিজের কাছেই বিশ্রী লাগছে। চিত্রা হাসফাঁস করছে। আমার মাথাটা ওর মুখের কাছে নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
‛শুনো না, খুব অস্বস্তি লাগছে এখানে।’
আমি চিত্রার হাতটা ধরলাম। বললাম,
‛একটু অপেক্ষা করো, দেখি কি করা যায়।’
চিত্রা মুখটা বিষণ্ণ করে বললো,
‛আমার না আর এক মুহূর্তও থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না এখানে।’
আমি চুপ রইলাম। কি বলবো বুঝতে পারছি না। সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া যতটা সহজ, ছাড়া পাওয়া অতোটা সহজ না। ছাড়পত্র চেয়েই বা কি হবে। আমাদের তো কোনো না কোনো হাসপাতালে যেতেই হবে। সব সরকারি হাসপাতালে একই অবস্থা। বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলে ছাড় দিবে, কিন্তু সেইটুকু সাধ্য নেই। চিত্রার যা কিছু সঞ্চয় ছিলো, সবটুকুই আমার হাতে দিয়ে দিয়েছে। টাকার হিসেবে সংখ্যাটা খুব বেশি না। হাজার চারেক টাকা এখানেই লাগবে। ওয়ার্ডের একজন সিনিয়ার নার্স আসলে বললাম,
‛এক বেডে দুইজন পেশেন্ট কিভাবে থাকবে আপা?’
‛রোগী বেশি আছে এখন। কমলে আলাদা সিট দেওয়া যাবে।’ বললো নার্স। আমি বললাম,
‛একটা আলাদা সিটের ব্যবস্থা করে দেন না?’
ইশারা দিয়ে একটু আড়ালে ডাকলো আমাকে। যেতেই বললো,
‛দুশো টাকা দিয়েন। কাল সকালের মধ্যে ব্যবস্থা করে দেবো।’
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এটা তো ঘুষ! তবুও রাজি হলাম। বললাম,
‛ঠিকআছে, টাকা লাগলে দিবো সমস্যা নেই।’
আসতে চাইলে বললো,
‛একশো টাকা দিয়ে যান এডভান্স।’
পকেটে হাত দিলাম। সবগুলো পাঁচশো টাকার নোট। নোটগুলো চকচকে। চিত্রার জমানো টাকা ছিলো এগুলো। টাকাগুলো নিজের হাতে খরচ করতে চিত্রার নিশ্চয় মায়া লাগতো। আমার মায়া লাগবে না!
‛খুচরো করে দিচ্ছি।’ বলে চলে এলাম।
টাকা খুচরো করতে হাসপাতালের বাইরে আসতে হলো। হাসপাতালের পরিবেশ আমার অচেনা। সেই সাথে পথও। ঢুকেছিলাম দু নম্বর গেট দিয়ে। বের হয়ে দেখি ইমারজেন্সি গেটে দাঁড়িয়ে। অ্যাম্বুলেন্সের সামনে একটা লাশ ঘিরে ছোট খাটো জটলা। লাশ অ্যাম্বুলেন্সে করে গ্রামে নেওয়া হবে। ঢাকার আত্মীয়-স্বজনরা গ্রামে যাবে না। শেষবারের মতো মৃত মানুষের মুখটা দেখে একে একে বিদায় নিচ্ছে। কেউ কেউ আবার লাশের পাশ ঘেষে কান্না জুড়ে দিচ্ছে। হাসপাতালে বেশিরভাগ কান্না অরজিনাল হয় না। কোনোরকমে ফর্মালিটি রক্ষা করে বিদায় নিতে পারলেই বাঁচা যায়। মানুষ মরে গেলে লাশটা তখন তুচ্ছ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। বরযাত্রী যাবার সময় বরের গাড়িতে আত্মীয়-স্বজনের জায়গা ধরে না। অথচ, মৃত মানুষের লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সে উঠানোর মতো মানুষ সহজে পাওয়া যায় না। জটলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি দাড়িয়ে দেখলাম। শেষে অ্যাম্বুলেন্সে উঠলো মাত্র তিনজন মানুষ। ড্রাইভারের পাশে বসা মধ্যবয়স্ক যুবকটা দূরের কোনো আত্মীয় হবে হয়তো। চোখে মুখে শোকের ছায়া নেই। লাশের সাথে পাঁচ কি ছয় বছরের বাচ্চা কোলে নিয়ে একটা অল্পবয়সী মেয়ে উঠলো। বাচ্চাটা চিপস হাতে নিয়ে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে গেছে। মেয়েটি মৃত মানুষটার মেয়ে হতে পারে হয়তো। একটু পর পর আলতো করে আঁচলে চোখ মুছছে। একটু আগে লাশের সামনে যাদের কান্না দেখেছি, গেট থেকে অ্যাম্বুলেন্স বের হবার আগেই তারা চলে গেছে। লাশের পাশে এই মেয়েটার কান্না একবারও শুনি নি। গ্রামের আঁকাবাঁকা রাস্তায় গিয়ে মেয়েটা হয়তো চিৎকার জুড়ে দিবে, কিন্তু সে চিৎকার গাড়ির কাঁচ বেদ করে কারো কানে পৌঁছাবে না। খুব বেশি কাছের মানুষেরা প্রিয়জন হারানোর কান্না কাউকে শুনাতে পারে না!
ইমারজেন্সি গেট দিয়ে বের হয়ে একটু সামনে এগুতেই হাসপাতালের মেইন গেট চোখে পড়লো। বিকেল চারটার পর বন্ধ থাকে। উপরে বড় করে লেখা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। হাসপাতালের মূল ভবনটি অনেক পুরোনো। পরবর্তীতে সাথে নতুন ভবন সংযুক্ত করা হয়েছে। সামনের রাস্তায় সারি সারি ভাসমান দোকান। মধ্যবিত্তের হাসপাতাল। দোকানগুলোতে খাবারের আইটেমও সেরকমই। চা-সিগারেট, রুটি, কলা, বাচ্চাদের চিপস, বিস্কিট সহ মোটামুটি ভালো কিছুই পাওয়া যায়। ভাবলাম এতো ছোট দোকানে হয়তো পাঁচশো টাকার নোট খুচরো হবে না। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বললাম,
‛কাকা পাঁচশো ভাংতি হবে?’
জিজ্ঞেস করলো,
‛কি নিবেন?’
বললাম,
‛বেশি কিছু নিবো না। কিন্তু ভাংতির খুব দরকার ছিলো।’
দোকানদার ক্যাশ বাক্সের দিকে তাকিয়ে বললো,
‛কি নিবেন নেন, আছে ভাংতি।’
বুঝলাম টাকা খুচরো করানোর জন্য কিছু অন্তত কিনতেই হবে। ক্ষুধা যে লাগছে এতক্ষন টের পাই নি। হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করলে ক্ষুধার কথা তেমন মনে থাকে না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কিছু না খেয়ে এখান থেকে উঠেই দাঁড়াতে পারবো না। বেলাও তো কম হয় নি। দুপুর পেরিয়ে গেছে। পেট ভরার মতো খাবার বলতে এখানে রুটি আর কলাই। কলার দাম পাঁচ টাকা, রুটির দামও পাঁচ টাকা। কলা দিয়ে একটা রুটিতে পেট ভরবে না। দুটো রুটিই পানি দিয়ে ভিজিয়ে খেয়ে ফেললাম। অতিরিক্ত আরো দুই টাকা খরচ হলো দুই গ্লাস পানির দাম। বারো টাকায় মধ্যবিত্তের লাঞ্চ, খারাপ না। চিত্রার জন্য পানিই কিনলাম পনেরো টাকায়। সাথে পঁচিশ টাকায় একটা নরম পাউরুটি। হাসপাতালে ঢুকার পথে দেখি ভ্যানে করে আম বিক্রি হচ্ছে। চিত্রার আম পছন্দ। সত্তর টাকায় এক কেজি পাকা আম নিলাম।
হাসপাতালে ফিরতে এমনভাবে নার্স আপা টাকাটা নিলো, যেনো এই একশো টাকার নোটটা তেমন মূল্যবান কিছু না। একটা কাগজে শুধু এক এর সাথে বড় বড় দুটো শূন্য দেওয়া। কিন্তু উনি বুঝতেই পারলো না, এই মুহূর্তে আমার পকেটে এই টাকাটার মূল্য কতখানি। টাকাটা হাতে নিয়ে বললো,
‛এই কথা কারো কাছে বলার দরকার নেই, ঝামেলায় পড়বেন। পরে আমাকে আর কোনো উপকারে পাবেন না।’
আমি বললাম,
‛আমি কারো কাছে বলতে যাবো কোনো আপা। আমার শুধু একটা বেড পেলেই হলো। খুব উপকার হবে।’
‛আচ্ছা। সকালে দেখবেন সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।’ বলে চলে গেলো।
চিত্রার চোখ ছলছল করছে। যেনো চোখ দুটো কাউকে খুঁজছে এবং খুঁজে না পেলে এইমাত্র কান্না করে দিবে। হাতে স্যালাইন লাগানো হয়েছে। আমি পাশে গিয়ে বসতেই ডান হাতে আমার একটা হাত চেপে ধরে কাঁপা স্বরে খুব আস্তে বললো,
‛মিহির?’
‛কিছু বলবে?’
‛এই স্যালাইনের সূচটা খুলে ফেললে হয় না?’
বললাম,
‛কোনো? এটা খুলবে কেনো?’
চিত্রা কেঁদে দিলো। বললো,
‛আমি কতো চিৎকার করলাম, তাও আমার কথা শুনলো না। হাতের মধ্যে এরকম একটা সূচ ঢুকিয়ে দিলো। আমার খুব ভয় হচ্ছে জানো?’
জিজ্ঞেস করলাম,
‛ব্যথা পাচ্ছো?’
'না। কিন্তু ভয় হচ্ছে। তুমি প্লিজ থাকো আমার কাছে, যেয়ো না।’
চিত্রার চোখের জল দেখতে পাচ্ছি। গাল বেয়ে পড়ছে।
সেই সাথে সাথে আরো একজোড়া চোখ জলে ভিজে যাচ্ছে, তা কেউ হয়তো দেখছে না। আমার চিত্রাকে এখানে একা রেখে যেতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু মহিলাদের এই ওয়ার্ডে পুরুষরা বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। চিত্রাকে কি বলবো ভেবে পাই না। আমার চোখে জল দেখলে ও জোরে কান্না করে দিবে। তা হতে দেওয়া যাবে না। আমাকে শক্ত থাকতে হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। হাত ছাড়াতে চাইলে চিত্রা হাত ছাড়লো না। অন্য হাতে আমের প্যাকেটটি উঠাতেই ওয়ার্ডের দায়িত্বরত নার্স আঙ্গুল দিয়ে কি যেনো ইশারা করলো, একজন আয়া আসলো ছুটে। বললো,
‛রোগীরে তো আর কিছু খাওয়ানো যাইবো না ভাই।’
আমি মানতেই পারলাম না। বললাম,
‛না খেলে মানুষ বাঁচে নাকি, কি আশ্চর্য।’
আয়া বললো,
‛আমার কথা আমি বইলা গেলাম। খাওয়া নিষেধ আছে। আপনে বড় আপার লগে কথা কন গিয়া।’
কথার গোলমাল শুনে নার্স নিজেই আসলো। চিত্রার হাতে লাগানো স্যালাইনের লাইনটা পরখ করতে করতে বললো,
‛খাবার খাওয়ানোর কোনো প্রয়োজন নেই। স্যালাইন লাগানো আছে সমস্যা হবে না।’
বললাম,
‛কতোদিন না খেয়ে থাকবে?’
‛অস্ত্রোপচারের আগ পর্যন্ত কিছু দেওয়া যাবে না মুখে। খাবার পেটে গেলে সমস্যা আছে।’
আমের প্যাকেটটা বেডের নিচে রেখে দিলাম। যেতে গিয়ে আবার ফিরে এলো নার্স। বললো,
‛খাবারের প্যাকেটা নিয়ে আপনি বাইরে চলে যান, মেয়ে মানুষ কাউকে পেশেন্টের কাছে রেখে যান।’
চিত্রা এতক্ষণ শুধু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। চোখ ঘুরিয়ে নার্সের দিকে তাকিয়ে বললো,
‛আপা, আমাদের সাথে আর কেউ তো আসে নি। ওকে একটু থাকতে দেন না?’
নার্স কঠিন বাসায় বললো,
‛পুরুষ মানুষ এখানে বেশিক্ষন থাকা নিষেধ।’
চিত্রার চোখ দিয়ে আবার পানি বেরিয়ে এলো। বললো,
‛কাউকেই তো চিনি না চারপাশে। হটাৎ হটাৎ শরীর একটু খারাপ লাগলে খুব ভয় করে। ও থাকলে ভয়টা লাগতো না।’
চিত্রা কথাগুলো বলছে হাসপাতালের নিয়মের বাইরে। ওয়ার্ডের সামনে বড় করে লেখা আছে, ‛ওয়ার্ডে পুরুষের অবস্থান করা নিষেধ।’
তারপরেও পুরুষ মানুষ ঢুকতে পারে। রোগীর সাথে দেখা করেই চলে যায়। রোগীর সাথে সার্বক্ষণিক মহিলা আত্মীয় স্বজন কেউ একজন থাকে। চিত্রার কথা শুনে নার্সের বিরক্ত হবার কথা ছিলো, কিন্তু হলো না। আমাকে বললো,
‛ভাই একটা কাজ করেন, আপনি বারান্দায় একটা মাদুর পেতে বসেন গিয়ে। একটু পর পর আইসেন এখানে। একনাগাড়ে থাকা যাবে না। নিয়ম-কানুন আছে তো।’
চিত্রা তবুও হাত ছাড়লো না। জানি হাত ছাড়তেই ও কান্না করে দিবে। কান্না আমারও আসে কিন্তু আমি চেপে রাখতে পারি, চিত্রা পারে না। দুঃখ কষ্ট কিংবা কান্না লুকিয়ে রাখবার মতো গুন পুরুষের আছে, নারীর তেমন নেই। কিন্তু থাকার দরকার ছিলো। চিত্রাকে আরো শক্ত হওয়ার দরকার ছিলো। আমার অন্য হাত দিয়ে চিত্রার হাতটা ছাড়ালাম। আলতো করে ওর বুকের উপরে রাখলাম। চিত্রা কিছু বললো না, কিন্তু ওর জলে ভেজা চোখ কি যেনো বলছে। চোখকে তো আর কথা বলা থেকে আটকে রাখা যায় না।
ওয়ার্ডের দরজা ঘেঁষে বের হবার পথে নার্স বললো,
‛ভাই রাত আটটার পর কিন্তু আর বারান্দায় থাকতে পারবেন না। মহিলা আত্মীয় কেউ একজনকে খবর দিয়ে রোগীর পাশে রেখে যান।’
এই কথাটা চিত্রা শুনে নি। শুনলে চিত্রার কষ্ট বাড়তো। আত্মীয় কাকে খবর দিবো? চিত্রা জানে, এই শহরে আমি ছাড়া ওর যে আর কেউ নেই! শহরে নেই আমারও কেউ চিত্রা ছাড়া!
ঢাকায় আমার যাপিত জীবন পুরোটাই চিত্রার ছত্রছায়ায়। সব ছেড়েছুড়ে সেই কবেই তো চলে এসেছি। চিত্রার সাথে কতোটা পথ হেঁটেছি। আরো পথ বাকি আছে, জানিনা কতদূর!
ইন্টারমিডিয়েট পাস করে যেদিন বললাম শহরে যাবো পড়াশোনা করবো, সেদিনই কয়েকটি গরুর গলায় বাঁধা রশি হাতে বাবা আমাকে পাঠিয়ে দিলেন করতোয়া নদীর পাড়ে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নদীর পাড়ে গরু চড়াই। সূর্য ডুবার আগ মুহূর্তে নদী বড্ড বেশি শান্ত লাগে। আমি তখন ঘাসের উপর শুয়ে পরি। ঝাঁকে ঝাঁকে পানকৌড়ি নদীতে মাছ শিকার করে। এরা কি সুন্দর উড়তে পারে আবার ডুবে ডুবে সাঁতারও কাটতে পারে। নদীতে সাঁতার কাটতে নামলে আমারও তখন উড়তে ইচ্ছে হয়। উড়তে পারলে মুক্ত ডানা ঝাপটিয়ে সবার আগে এই করতোয়া নদী পাড়ি দিতাম। আমি চিৎকার করি,
'ডানা চাই ডানা চাই, মুক্তি চাই মুক্তি চাই!'
আমার চিৎকার ঈশ্বরের কান অব্দি পৌঁছায় না, নদীর প্রবল স্রোতের শব্দে মিলিয়ে যায়। তাইতো মুক্তি মিলে না। আর্তনাদ যখন ঈশ্বর শুনতে পায় না, আমি তখন কবিতার খাতা বের করি। মুক্তির আকাঙ্ক্ষা আমি কবিতায় লিখে রাখি!
গরু চড়িয়ে সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরি। ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিয়ে যখন চোখ বুজি, পাশের খোপ থেকে ভাতের পাতিল কাঁচানোর শব্দ আসে। সৎ মায়ের সংসার। রাতের খাবারে কোনোদিন পেট পুরে না। ঘুমানোর আগে পাশের খোপ থেকে কানে শব্দ ভাসে, ‛পোলা এতো বড় হইছে, অহনো বাপের ঘাড়ে বইসা অন্ন গিলে। অর হোমাইন্না পোলাপাইন হাওরে ধান কাইট্টা ডেলি দেড়শো টেহা বাপ-মার হাতো দেয়। আর আমার পোড়া কোপাল, ঘরে এমন ডাঙর পোলা থাকতেও দুইডা টেহা পর্যন্ত কামাইয়ের মুখ দেখলাম না।’
বাবা প্রতিদিন একই কথা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যান।
একদিন সকালে ভোরে ঘুম থেকে তুলে আমান কাকার সাথে আমাকে হাওরে পাঠিয়ে দেন ধান কাটতে। সারাদিন ধান কাটি, রাতে গেরোস্তের বাড়িতে থাকি। আমার বদলার টাকা সব আমান কাকার হাতে চলে যায়। ধানকেটে সপ্তাহখানেক বাদে বাড়ি ফেরার সময় আমান কাকাকে বলি,
‛আমার বদলার টাকা আমাকে দিয়ে দাও না কাকা। আমি শহরে যাবো, পড়াশোনা করবো।’
আমান কাকা টাকা দেয় না। বলে,
‛এহনো পড়াশোনা করলে, বাপ-মারে কামাই কইরা খাওয়াবি কবে?’
আমি বলি,
‛স্বপ্ন পূরণ না হলে, কামাই করে কি করবো কাকা?’
কাকা পা চালানো থামিয়ে দেয়। বলে,
‛কামাই করবি বাপ-মারে খাওয়াইতে। ছোডো বেলায় মা মরছে, সৎ মা হইলেও পাইল্লা বড় করছে। এহন বড় হইছস রোজগার করবি, বাপ-মারে খুশি করবি।’
আমি ভয় পাই। তবুও বলি,
‛কাকা আমি পড়াশুনা করবো আরো।’
কাকা চোখ বড় বড় করে তাকায়। বলে,
‛ইন্টার পাস করছস, আর পড়াশোনা দিয়া কি করবি? যা পড়ছস, এইটুকু দিয়াই বীরগঞ্জে মেলা কাজ পাবি।’
আমি আর কিছু বলি না। মাথা নিচু করে হাটা ধরি।
বাড়ি গিয়ে আমার খুব মন খারাপ হয়। আমান কাকা সবগুলো টাকা বাবাকে দিয়ে দেয়। সেদিন চুলায় বড় পাতিলে ভাত রান্না হয়। রাতে পাতিল কাঁচানোর শব্দ কানে ভাসে না। পেট পুরে খাই। পেট ভরপুর থাকলে মেজাজ ফুরফুরে থাকে। মস্তিষ্কে তখন কবিতার লাইন বাসা বাঁধে। কিন্তু ততক্ষণে হারিকেনের তেল ফুরিয়ে যায়। অন্ধকারে কবিতার লাইনগুলো মস্তিস্কেই পুষে রাখি।
হাটের দিনে পাইসা বিল থেকে শাপলা কুঁড়িয়ে আনি। প্রতিমোটা শাপলা একটাকা দরে বিক্রি করি। হাট থেকে ফেরার পথে পেন্সিল আর মোমবাতি কিনে আনি। রাতে হারিকেনের তেল ফুরিয়ে গেলে মোমের আলোয় কবিতা লিখি।
বর্ষাকালে জলাশয়ের পাড় ধরে যখন ডিঙি নৌকা বাই, তখন পাড়ার অল্পবয়সী তরুণীদের দেখা মিলে। জলাশয়ে তখন লাল পদ্ম ফোটে। বুকে উড়না পেঁচিয়ে তরুণীর দল জলাশয়ে নেমে পরে। দু-একটা পদ্ম ছিড়ে চুলের খোঁপায় গুঁজে। মাঝে মাঝে এদের মাথায় টপ টপ বৃষ্টির ফোটা পরে। বৃষ্টির পানি কপালের চুল চুইয়ে চোখের পাঁপড়ি স্পর্শ করে পদ্ম পাতায় পরে। আমি তখন আকাশ ডেকে রাখা মেঘের কথা ভুলে যাই। বৃষ্টিতে নিজে ভিজে যাচ্ছি, সেকথাও ভুলে যাই। আমি শুধু তাকিয়ে থাকি পদ্ম পাতার দিকে। কোনো কিশোরীর চোখে তাকাতে ভীষণ ভয় করে। যদি মুগ্ধতা আমায় স্পর্শ করে ফেলে। ভাবি; কোনোভাবেই জড়ানো যাবে না মুগ্ধতার জালে। মনে প্রেম আসবে প্রকৃতির নিয়মে। যৌবনের ডাকে সাড়া দিয়ে প্রেম মন থেকে পরক্ষনে শরীরে ছেয়ে যাবে। ভীষণ করে কাউকে ছুঁতে ইচ্ছে করবে। প্রকৃতির নিয়ম রুখে দেবার ক্ষমতা তো নেই জানি। কিন্তু ভেবে রাখি, যাবো না আর জলাশয়ের পাড়ে কোনো বর্ষায়। আমার যেইটুকু প্রেম, লিখে রাখি শুধু কবিতার খাতায়। এভাবে একদিন খাতা কবিতায় ভরে যায়। স্থানীয় শালবন পত্রিকা আমার একটি কবিতা ছাপে। বীরগঞ্জে কবিতার প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ে।
শালবনের সম্পাদক আমাকে একদিন নিয়ে গেলেন পাইলট স্কুলের সুবর্ণ জয়ন্তীতে। অনেক বড় করে অনুষ্ঠান হচ্ছে। আমাকে বললেন স্টেজে উঠে কবিতা আবৃত্তি করতে। স্টেজে উঠলাম, নিজের লেখা একটা কবিতা পড়লাম। ঘাড় ঘুরাতেই দেখি এক জোড়া অতি সুন্দর চোখ আমার দিকে তাকিয়ে। একদম জলপ্রপাতের মতো, যেখানে চিরকাল তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। আমার এভাবে চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকা ইচ্ছাকৃত নয়। প্রথম প্রেমে পড়ার অনুভূতি কি এমন হয়? হায় ঈশ্বর! এমন কেনো হলো? আমি তো কখনো প্রেমে পড়তে চাই নি!
চাহনি নামলো, মানুষটার স্নিগ্ধ নরম গলার স্বরে। কবিতার খাতাটার দিকে ইশারা করে বললো,
‛আমাকে একটু দিবা এটা?’
কবিতার খাতা চাওয়াতে আমি অবাক হলাম। বললাম,
‛কেনো?’
খুব আবদারের সুরে বললো,
‛সবগুলো কবিতা পড়েই দিয়ে দিবো। দিবা বলো?’
আমি কবিতার খাতাটা বাড়িয়ে দিলাম। বললাম,
‛আমি চলে যাবো তো। একটু তাড়াতাড়ি দিয়ে দিবেন প্লিজ।’
কবিতার খাতাটা এক হাতে ধরলো। বললো,
‛উহু, আপনি না। তুমি করে বলো।’
আবদারের সুর ছিলো কথায়। হৃদপিন্ডে গাঁথে সে কণ্ঠস্বর। আমি যেনো ক্রমেই দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। মানুষটার সারা শরীরে তাকালাম। ধবধবে ফর্সা ত্বক। কোমর অবধি চুল, সুযোগ পেলেই উড়তে চায়। কপালের চুল এসে কিছুটা মুখ ডেকে দিয়ে যায়। থুতনিতে টোল আছে। আমার প্রেম মন থেকে শরীরে ছেয়ে গেছে। জলপ্রপাত ছেড়ে আমার চোখ গিয়ে থেমেছে গোলাপি ঠোঁটযুগলে! এমন কেনো হলো?
সোনালী পাড়ের হালকা সবুজ সিল্কের শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে থাকা অতি রূপবতী এই মেয়েটির কপালে সিঁদুর আছে! দুহাতে সবুজ কাঁচের চুরির সাথে সাদা রঙের শাখা ঝকঝক করছে। একজন বিবাহিত নারীর সামনে দাঁড়িয়ে মনে প্রেমের আল্পনা আঁকছি! নিজেই লজ্জিত হলাম নিজের উপর। সংকোচ কাটিয়ে বললাম,
‛তুমি বলতে কেমন লাগছে না? বয়স আমার আসলে তেমন না। তাছাড়া আপনি বিবাহিত।’
ব্রু কুঁচকে বললো,
‛বিবাহিত তো? কথা বলবে না? কবিতার খাতা নিয়ে নিবে?’
কণ্ঠস্বরে কিছুটা রাগ, কিছুটা বিরক্তি।
আমি ও তেমন ভাবেই জবাব দিলাম,
‛না, তা কেনো।’
তারপর নীরবতা। কিন্তু নীরবতা আমার ভালো লাগে না। ভালো লাগে মুগ্ধ করতে, হাসাতে, চমকে দিতে। সামনে দাঁড়ানো মানুষটিকে চমকে দিতে হটাৎ দ্রুতবেগে পকেট থেকে হাত বের করে সামনে বাড়িয়ে দিলাম! ‛আচ্ছা আমি মিহির মুহাম্মদ।’
চমকাতে পেরেছি কিনা জানি না, কিন্তু বিস্ময়ের হাসি মানুষটার ঠোঁটে। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করলো, যে স্পর্শে মানুষ হিম হয়ে যায়! ধীরে ধীরে হাসি ঠোঁটের কিনারে ছড়িয়ে পড়লো। খুব আস্তে করে বললো,
‛আমি চিত্রা।’
খুব অল্প সময়েই দারুন সখ্যতা হলো। পাইলট স্কুলের মাঠে সারাদিন দুজনে একসাথে হেসে খেলে কাটিয়ে দিলাম। কবিতার খাতা নিলো ঠিক, পড়লো না। স্কুলের বারান্দায় রেলিংয়ে হেলান দিয়ে বসে ছিলাম দুজন। বললাম,
‛খাতা দিবে না আমার?’
আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে চিত্রা বলে,
‛এখনি চাই খাতা?’
বললাম,
‛না। কিন্তু তুমি যে পড়লে না কবিতা।’
চিত্রা খাতাটা খুলে। বলে,
‛দুর্গোপুজোয় আমার শশুরবাড়িতে এসো। ততোদিনে সবগুলো কবিতা পড়ে শেষ করে রাখবো।’
আমি বললাম,
‛খাতা আনতে তোমার শশুরবাড়ি যাবো?’
‛হুম যাবা। এমনিতে পূজোয় নিমন্ত্রন করলে তো যাবা না। এখন এই কবিতার খাতার জন্য হলেও যাবা।’
চিত্রা এমনভাবে কথাগুলো বললো, ঘাড় কাত করে সম্মতি দেওয়া ছাড়া উপায় ছিলো না। আবার বললো,
‛যাবা তো?’
বললাম, ‛আচ্ছা যাবো।’
চিত্রা উঠে দাঁড়ায়। বলে,
‛শিবরামপুরে, হরিরাজ ব্যানার্জির বাড়িতে। নবমীর দিনে। মনে থাকবে?’
আমি আবার ঘাড় কাত করলাম। যেনো জোর করে সম্মতি নিলো। পুরুষ মানুষের এই এক দুর্বলতা; রূপবতী মেয়েদের কথায় সহজে সম্মতি না দিয়ে পারে না!
চিত্রা চলে গেলে আমি বসে থাকি ওখানেই। কেমন অদ্ভুত লাগছে সবকিছু। সত্যিই কি প্রেমে পড়লাম! কিন্তু কেনো? চিত্রা তো বিবাহিত। স্বামীর সাথে এসেছে সুবর্ণ জয়ন্তীতে। মাঝখানে কেনো শুধু শুধু আমার সাথে পরিচয় হতে হলো। যা আমি ভাবছি, তা হবার নয় কখনো। আমাকে ভুলে যেতে হবে। আজকের দিনটি পুরোপুরি ভুলে যেতে হবে।
বাড়ি এসে চিত্রাকে একরকম ভুলেই যাই। আমি আবার ফিরে যাই করতোয়ার তীরে, রাখাল বালকের বেশে। দুর্গো পূজোর সময় বাড়িতে ফসল উঠে। দিনে ফসল মাড়াই, রাতে ক্লান্ত শরীরে মরা মানুষের মতো ঘুমাই। নবমী চলে যায়, দশমীর দিনে ঢেপা নদীতে দেবী দুর্গার বিসর্জন হয়। তারপর আরো অনেক সময় ফুরিয়ে যায়, শীত আসে। চিত্রার কাছে গিয়ে কবিতার খাতা আনা হয় না। কিন্তু চিত্রাকে মনে পড়ে হটাৎ হটাৎ। আমার এভাবে প্রেমে পড়ার খবর তো ও জানতো না। জানার কথাও না কারণ, প্রেম এখানে অসম্ভব। আমাদের ধর্মটা আলাদা বলে না। কারণটা হলো চিত্রা বিবাহিত। এ দেয়াল টপকানো সম্ভব না। কিন্তু বন্ধু হওয়া যেতে পারতো। চিত্রাও তাই চেয়েছিলো। কিন্তু আমিই কোনো তা হতে দিলাম না? ভেবে দেখলাম, সময় ফুরিয়ে যায় নি তো। সুযোগ আছে ক্ষমা চাওয়ার।
একদিন সকাল ভোরে গায়ে চাদর জড়িয়ে গেলাম শিবরামপুরে। গ্রামে ঢুকেই বুঝলাম, চিত্রা কোনো পুরো ঠিকানা না দিয়ে শুধু হরিরাজ ব্যানার্জির নাম বলে চলে এসেছিলো। বনে সিংহের দলপতিকে যেমন হরিরাজ ডাকা হয়; এই গ্রামেও হরিরাজ ব্যানার্জি তেমনি একজন। ছোট, বড় সবাই তাকে খুব চিনে। কেউ ভয় পায়, কেউ আবার ভীষণ রকমের শ্রদ্ধাও করে। আমার ভয় হয়। বাড়িতে যাবার সাহস করি না। আশেপাশে মানুষের কাছ থেকে খবর নেই। ছোট ছেলে রুপম ব্যানার্জি কলকাতায় আর্ট কলেজে পড়তো। কলকাতা থেকে ফেরার পথে চিত্রাকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গের বড় শহর কলকাতায় বেড়ে উঠা চিত্রা উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি গ্রামে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেনি। পূজোর পরপরই রুপম ব্যানার্জি চিত্রাকে নিয়ে ঢাকায় চলে গেছে। কথাগুলো বলেছিলেন রুপম ব্যানার্জির শৈশবের বন্ধু কেশব বাবু। উনি আমাকে ঢাকায় চিত্রার ঠিকানা যোগাড় করে দিলেন। চিত্রাকে না পেয়ে মন খারাপ হলো। নম্বর যোগাড় করা গেলে টেলিফোনে চিত্রার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া যেতো। এখন সেই সুযোগ নেই। একমাত্র উপায় চিঠি লিখা। ক্ষমা চাইলাম না, কবিতার খাতা ফেরত চেয়ে চিত্রাকে চিঠি লিখলাম। নয় দিন পর উত্তর হাতে পাই। খুব ছোট একটি চিঠি:
‛মিঃ মিহির,
কতো অপেক্ষা করেছি জানো? ঢাকায় আসার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তাকিয়ে ছিলাম পথের দিকে। তুমি আসলে না। খুব রাগ হয়েছিলো। ভেবেছিলাম দেখা হলেও আর কোনোদিনও কথা বলবো না। কিন্তু কি আর করার বলো। তোমার কবিতার খাতাটা পুরোপুরি পড়ে ফেলেছি আমি। একটাও কবিতা নেই। পুরোটা যেনো লাইফ স্টোরি! ঢাকায় আসো শীগ্রই। আমি সব ঠিক করে দিবো। পূজোয় না আসার শাস্তিও অবশ্য দিবো।চিঠি হাতে পেয়েই টেলিফোন করো। বাকিটা টেলিফোনেই বলবো। দেরি করলে শাস্তি বাড়বে। মনে থাকবে?
ইতি
চিত্রা।’
চিঠি পড়ে অনেক ভাবলাম। চিত্রা চিঠির জবাব চায় নি। সরাসরি টেলিফোন করতে বলেছে। ইচ্ছে করলেই বাজারে গিয়ে চিঠিতে দেওয়া নম্বরে টেলিফোন করতে পারি। কিন্তু তার আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ভেবে দেখলাম, যে কবিতার খাতা চিত্রার হাতে সেখানে এক একটা কবিতায় আমার জীবন আঁকা আছে। করতোয়ার পাড়ে বসে বসে যে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা আমি লিখেছি, সবটা চিত্রা জেনে গেছে! জেনে গেছে আমার দুঃখ দুর্দশায় সবটা যাপিত জীবন! যে স্বপ্নগুলো আমি লিখেছি কবিতার খাতায়, তা পূরণ করানোর তাড়না এখন চিত্রার মাথায়! আমি ঢাকায় যেতে চেয়েছি। পড়াশুনা করতে চেয়েছি। কিন্তু এভাবে চাই নি। প্রেমে পড়তে চাই নি। তবুও বন্ধুত্ব নামক সম্পর্কের আড়ালে প্রেমও তো লুকানো সম্ভব। আমার সবটুকু প্রেম নাহয় আবছা আলোয় লুকিয়ে লিখে রাখবো কবিতার খাতায়।
দুদিন পর চিত্রাকে টেলিফোন করি। টেলিফোনে প্রতিটা কথাই মূল্যবান। প্রতি মিনিট ফুরালেই দুটাকা করে কেটে নিবে দোকানী। ওপাশ থেকে ‛হ্যালো’ বলতেই বললাম,
‛চিত্রা আমি আসবো ঢাকায়।’
চিত্রার কণ্ঠে বিস্ময়। বলে,
‛সত্যি? এবার আর ফাঁকি দিবা না তো?’
‛একদম ফাঁকি দিবো না। আর শুনো, সরি হ্যাঁ?’
খানিকক্ষণ নীরবতা। তারপর বলে,
‛চুপ। ক্ষমা করবো না। দেরিতে আসলে শাস্তি বাড়বে।’
টেলিফোনেই হাসি চলে আসে আমার। বলি,
‛ঠিকআছে দিও শাস্তি। ইন্টারের সার্টিফিকেট টা তুলতে পারলেই চলে আসছি।’
চিত্রার কণ্ঠ হটাৎ নেমে যায়। বলে,
‛খুব দ্রুত আসো মিহির। নিঃসঙ্গতা আর ভালো লাগে না!’
‛নিঃসঙ্গতা?’ বলতেই চিত্রা ফোন কেটে দেয়।
আমার মাথায় ঢুকে না চিত্রার জীবনে নিঃসঙ্গতা কিভাবে আসতে পারে। স্বামী সংসার থাকতেও একটা নারীর জীবনে নিঃসঙ্গতা ভর করতে পারে? এই অদ্ভুত একটা প্রশ্নই আমাকে মাতিয়ে রেখেছিলো; মধ্যরাতে একতা এক্সপ্রেসে চড়ে দিনাজপুর ছেড়ে ঢাকায় আসার পথটুকু।
‛শুনো না, খুব অস্বস্তি লাগছে এখানে।’
আমি চিত্রার হাতটা ধরলাম। বললাম,
‛একটু অপেক্ষা করো, দেখি কি করা যায়।’
চিত্রা মুখটা বিষণ্ণ করে বললো,
‛আমার না আর এক মুহূর্তও থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না এখানে।’
আমি চুপ রইলাম। কি বলবো বুঝতে পারছি না। সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া যতটা সহজ, ছাড়া পাওয়া অতোটা সহজ না। ছাড়পত্র চেয়েই বা কি হবে। আমাদের তো কোনো না কোনো হাসপাতালে যেতেই হবে। সব সরকারি হাসপাতালে একই অবস্থা। বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলে ছাড় দিবে, কিন্তু সেইটুকু সাধ্য নেই। চিত্রার যা কিছু সঞ্চয় ছিলো, সবটুকুই আমার হাতে দিয়ে দিয়েছে। টাকার হিসেবে সংখ্যাটা খুব বেশি না। হাজার চারেক টাকা এখানেই লাগবে। ওয়ার্ডের একজন সিনিয়ার নার্স আসলে বললাম,
‛এক বেডে দুইজন পেশেন্ট কিভাবে থাকবে আপা?’
‛রোগী বেশি আছে এখন। কমলে আলাদা সিট দেওয়া যাবে।’ বললো নার্স। আমি বললাম,
‛একটা আলাদা সিটের ব্যবস্থা করে দেন না?’
ইশারা দিয়ে একটু আড়ালে ডাকলো আমাকে। যেতেই বললো,
‛দুশো টাকা দিয়েন। কাল সকালের মধ্যে ব্যবস্থা করে দেবো।’
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এটা তো ঘুষ! তবুও রাজি হলাম। বললাম,
‛ঠিকআছে, টাকা লাগলে দিবো সমস্যা নেই।’
আসতে চাইলে বললো,
‛একশো টাকা দিয়ে যান এডভান্স।’
পকেটে হাত দিলাম। সবগুলো পাঁচশো টাকার নোট। নোটগুলো চকচকে। চিত্রার জমানো টাকা ছিলো এগুলো। টাকাগুলো নিজের হাতে খরচ করতে চিত্রার নিশ্চয় মায়া লাগতো। আমার মায়া লাগবে না!
‛খুচরো করে দিচ্ছি।’ বলে চলে এলাম।
টাকা খুচরো করতে হাসপাতালের বাইরে আসতে হলো। হাসপাতালের পরিবেশ আমার অচেনা। সেই সাথে পথও। ঢুকেছিলাম দু নম্বর গেট দিয়ে। বের হয়ে দেখি ইমারজেন্সি গেটে দাঁড়িয়ে। অ্যাম্বুলেন্সের সামনে একটা লাশ ঘিরে ছোট খাটো জটলা। লাশ অ্যাম্বুলেন্সে করে গ্রামে নেওয়া হবে। ঢাকার আত্মীয়-স্বজনরা গ্রামে যাবে না। শেষবারের মতো মৃত মানুষের মুখটা দেখে একে একে বিদায় নিচ্ছে। কেউ কেউ আবার লাশের পাশ ঘেষে কান্না জুড়ে দিচ্ছে। হাসপাতালে বেশিরভাগ কান্না অরজিনাল হয় না। কোনোরকমে ফর্মালিটি রক্ষা করে বিদায় নিতে পারলেই বাঁচা যায়। মানুষ মরে গেলে লাশটা তখন তুচ্ছ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। বরযাত্রী যাবার সময় বরের গাড়িতে আত্মীয়-স্বজনের জায়গা ধরে না। অথচ, মৃত মানুষের লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সে উঠানোর মতো মানুষ সহজে পাওয়া যায় না। জটলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি দাড়িয়ে দেখলাম। শেষে অ্যাম্বুলেন্সে উঠলো মাত্র তিনজন মানুষ। ড্রাইভারের পাশে বসা মধ্যবয়স্ক যুবকটা দূরের কোনো আত্মীয় হবে হয়তো। চোখে মুখে শোকের ছায়া নেই। লাশের সাথে পাঁচ কি ছয় বছরের বাচ্চা কোলে নিয়ে একটা অল্পবয়সী মেয়ে উঠলো। বাচ্চাটা চিপস হাতে নিয়ে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে গেছে। মেয়েটি মৃত মানুষটার মেয়ে হতে পারে হয়তো। একটু পর পর আলতো করে আঁচলে চোখ মুছছে। একটু আগে লাশের সামনে যাদের কান্না দেখেছি, গেট থেকে অ্যাম্বুলেন্স বের হবার আগেই তারা চলে গেছে। লাশের পাশে এই মেয়েটার কান্না একবারও শুনি নি। গ্রামের আঁকাবাঁকা রাস্তায় গিয়ে মেয়েটা হয়তো চিৎকার জুড়ে দিবে, কিন্তু সে চিৎকার গাড়ির কাঁচ বেদ করে কারো কানে পৌঁছাবে না। খুব বেশি কাছের মানুষেরা প্রিয়জন হারানোর কান্না কাউকে শুনাতে পারে না!
ইমারজেন্সি গেট দিয়ে বের হয়ে একটু সামনে এগুতেই হাসপাতালের মেইন গেট চোখে পড়লো। বিকেল চারটার পর বন্ধ থাকে। উপরে বড় করে লেখা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। হাসপাতালের মূল ভবনটি অনেক পুরোনো। পরবর্তীতে সাথে নতুন ভবন সংযুক্ত করা হয়েছে। সামনের রাস্তায় সারি সারি ভাসমান দোকান। মধ্যবিত্তের হাসপাতাল। দোকানগুলোতে খাবারের আইটেমও সেরকমই। চা-সিগারেট, রুটি, কলা, বাচ্চাদের চিপস, বিস্কিট সহ মোটামুটি ভালো কিছুই পাওয়া যায়। ভাবলাম এতো ছোট দোকানে হয়তো পাঁচশো টাকার নোট খুচরো হবে না। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বললাম,
‛কাকা পাঁচশো ভাংতি হবে?’
জিজ্ঞেস করলো,
‛কি নিবেন?’
বললাম,
‛বেশি কিছু নিবো না। কিন্তু ভাংতির খুব দরকার ছিলো।’
দোকানদার ক্যাশ বাক্সের দিকে তাকিয়ে বললো,
‛কি নিবেন নেন, আছে ভাংতি।’
বুঝলাম টাকা খুচরো করানোর জন্য কিছু অন্তত কিনতেই হবে। ক্ষুধা যে লাগছে এতক্ষন টের পাই নি। হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করলে ক্ষুধার কথা তেমন মনে থাকে না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কিছু না খেয়ে এখান থেকে উঠেই দাঁড়াতে পারবো না। বেলাও তো কম হয় নি। দুপুর পেরিয়ে গেছে। পেট ভরার মতো খাবার বলতে এখানে রুটি আর কলাই। কলার দাম পাঁচ টাকা, রুটির দামও পাঁচ টাকা। কলা দিয়ে একটা রুটিতে পেট ভরবে না। দুটো রুটিই পানি দিয়ে ভিজিয়ে খেয়ে ফেললাম। অতিরিক্ত আরো দুই টাকা খরচ হলো দুই গ্লাস পানির দাম। বারো টাকায় মধ্যবিত্তের লাঞ্চ, খারাপ না। চিত্রার জন্য পানিই কিনলাম পনেরো টাকায়। সাথে পঁচিশ টাকায় একটা নরম পাউরুটি। হাসপাতালে ঢুকার পথে দেখি ভ্যানে করে আম বিক্রি হচ্ছে। চিত্রার আম পছন্দ। সত্তর টাকায় এক কেজি পাকা আম নিলাম।
হাসপাতালে ফিরতে এমনভাবে নার্স আপা টাকাটা নিলো, যেনো এই একশো টাকার নোটটা তেমন মূল্যবান কিছু না। একটা কাগজে শুধু এক এর সাথে বড় বড় দুটো শূন্য দেওয়া। কিন্তু উনি বুঝতেই পারলো না, এই মুহূর্তে আমার পকেটে এই টাকাটার মূল্য কতখানি। টাকাটা হাতে নিয়ে বললো,
‛এই কথা কারো কাছে বলার দরকার নেই, ঝামেলায় পড়বেন। পরে আমাকে আর কোনো উপকারে পাবেন না।’
আমি বললাম,
‛আমি কারো কাছে বলতে যাবো কোনো আপা। আমার শুধু একটা বেড পেলেই হলো। খুব উপকার হবে।’
‛আচ্ছা। সকালে দেখবেন সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।’ বলে চলে গেলো।
চিত্রার চোখ ছলছল করছে। যেনো চোখ দুটো কাউকে খুঁজছে এবং খুঁজে না পেলে এইমাত্র কান্না করে দিবে। হাতে স্যালাইন লাগানো হয়েছে। আমি পাশে গিয়ে বসতেই ডান হাতে আমার একটা হাত চেপে ধরে কাঁপা স্বরে খুব আস্তে বললো,
‛মিহির?’
‛কিছু বলবে?’
‛এই স্যালাইনের সূচটা খুলে ফেললে হয় না?’
বললাম,
‛কোনো? এটা খুলবে কেনো?’
চিত্রা কেঁদে দিলো। বললো,
‛আমি কতো চিৎকার করলাম, তাও আমার কথা শুনলো না। হাতের মধ্যে এরকম একটা সূচ ঢুকিয়ে দিলো। আমার খুব ভয় হচ্ছে জানো?’
জিজ্ঞেস করলাম,
‛ব্যথা পাচ্ছো?’
'না। কিন্তু ভয় হচ্ছে। তুমি প্লিজ থাকো আমার কাছে, যেয়ো না।’
চিত্রার চোখের জল দেখতে পাচ্ছি। গাল বেয়ে পড়ছে।
সেই সাথে সাথে আরো একজোড়া চোখ জলে ভিজে যাচ্ছে, তা কেউ হয়তো দেখছে না। আমার চিত্রাকে এখানে একা রেখে যেতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু মহিলাদের এই ওয়ার্ডে পুরুষরা বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। চিত্রাকে কি বলবো ভেবে পাই না। আমার চোখে জল দেখলে ও জোরে কান্না করে দিবে। তা হতে দেওয়া যাবে না। আমাকে শক্ত থাকতে হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। হাত ছাড়াতে চাইলে চিত্রা হাত ছাড়লো না। অন্য হাতে আমের প্যাকেটটি উঠাতেই ওয়ার্ডের দায়িত্বরত নার্স আঙ্গুল দিয়ে কি যেনো ইশারা করলো, একজন আয়া আসলো ছুটে। বললো,
‛রোগীরে তো আর কিছু খাওয়ানো যাইবো না ভাই।’
আমি মানতেই পারলাম না। বললাম,
‛না খেলে মানুষ বাঁচে নাকি, কি আশ্চর্য।’
আয়া বললো,
‛আমার কথা আমি বইলা গেলাম। খাওয়া নিষেধ আছে। আপনে বড় আপার লগে কথা কন গিয়া।’
কথার গোলমাল শুনে নার্স নিজেই আসলো। চিত্রার হাতে লাগানো স্যালাইনের লাইনটা পরখ করতে করতে বললো,
‛খাবার খাওয়ানোর কোনো প্রয়োজন নেই। স্যালাইন লাগানো আছে সমস্যা হবে না।’
বললাম,
‛কতোদিন না খেয়ে থাকবে?’
‛অস্ত্রোপচারের আগ পর্যন্ত কিছু দেওয়া যাবে না মুখে। খাবার পেটে গেলে সমস্যা আছে।’
আমের প্যাকেটটা বেডের নিচে রেখে দিলাম। যেতে গিয়ে আবার ফিরে এলো নার্স। বললো,
‛খাবারের প্যাকেটা নিয়ে আপনি বাইরে চলে যান, মেয়ে মানুষ কাউকে পেশেন্টের কাছে রেখে যান।’
চিত্রা এতক্ষণ শুধু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। চোখ ঘুরিয়ে নার্সের দিকে তাকিয়ে বললো,
‛আপা, আমাদের সাথে আর কেউ তো আসে নি। ওকে একটু থাকতে দেন না?’
নার্স কঠিন বাসায় বললো,
‛পুরুষ মানুষ এখানে বেশিক্ষন থাকা নিষেধ।’
চিত্রার চোখ দিয়ে আবার পানি বেরিয়ে এলো। বললো,
‛কাউকেই তো চিনি না চারপাশে। হটাৎ হটাৎ শরীর একটু খারাপ লাগলে খুব ভয় করে। ও থাকলে ভয়টা লাগতো না।’
চিত্রা কথাগুলো বলছে হাসপাতালের নিয়মের বাইরে। ওয়ার্ডের সামনে বড় করে লেখা আছে, ‛ওয়ার্ডে পুরুষের অবস্থান করা নিষেধ।’
তারপরেও পুরুষ মানুষ ঢুকতে পারে। রোগীর সাথে দেখা করেই চলে যায়। রোগীর সাথে সার্বক্ষণিক মহিলা আত্মীয় স্বজন কেউ একজন থাকে। চিত্রার কথা শুনে নার্সের বিরক্ত হবার কথা ছিলো, কিন্তু হলো না। আমাকে বললো,
‛ভাই একটা কাজ করেন, আপনি বারান্দায় একটা মাদুর পেতে বসেন গিয়ে। একটু পর পর আইসেন এখানে। একনাগাড়ে থাকা যাবে না। নিয়ম-কানুন আছে তো।’
চিত্রা তবুও হাত ছাড়লো না। জানি হাত ছাড়তেই ও কান্না করে দিবে। কান্না আমারও আসে কিন্তু আমি চেপে রাখতে পারি, চিত্রা পারে না। দুঃখ কষ্ট কিংবা কান্না লুকিয়ে রাখবার মতো গুন পুরুষের আছে, নারীর তেমন নেই। কিন্তু থাকার দরকার ছিলো। চিত্রাকে আরো শক্ত হওয়ার দরকার ছিলো। আমার অন্য হাত দিয়ে চিত্রার হাতটা ছাড়ালাম। আলতো করে ওর বুকের উপরে রাখলাম। চিত্রা কিছু বললো না, কিন্তু ওর জলে ভেজা চোখ কি যেনো বলছে। চোখকে তো আর কথা বলা থেকে আটকে রাখা যায় না।
ওয়ার্ডের দরজা ঘেঁষে বের হবার পথে নার্স বললো,
‛ভাই রাত আটটার পর কিন্তু আর বারান্দায় থাকতে পারবেন না। মহিলা আত্মীয় কেউ একজনকে খবর দিয়ে রোগীর পাশে রেখে যান।’
এই কথাটা চিত্রা শুনে নি। শুনলে চিত্রার কষ্ট বাড়তো। আত্মীয় কাকে খবর দিবো? চিত্রা জানে, এই শহরে আমি ছাড়া ওর যে আর কেউ নেই! শহরে নেই আমারও কেউ চিত্রা ছাড়া!
ঢাকায় আমার যাপিত জীবন পুরোটাই চিত্রার ছত্রছায়ায়। সব ছেড়েছুড়ে সেই কবেই তো চলে এসেছি। চিত্রার সাথে কতোটা পথ হেঁটেছি। আরো পথ বাকি আছে, জানিনা কতদূর!
ইন্টারমিডিয়েট পাস করে যেদিন বললাম শহরে যাবো পড়াশোনা করবো, সেদিনই কয়েকটি গরুর গলায় বাঁধা রশি হাতে বাবা আমাকে পাঠিয়ে দিলেন করতোয়া নদীর পাড়ে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নদীর পাড়ে গরু চড়াই। সূর্য ডুবার আগ মুহূর্তে নদী বড্ড বেশি শান্ত লাগে। আমি তখন ঘাসের উপর শুয়ে পরি। ঝাঁকে ঝাঁকে পানকৌড়ি নদীতে মাছ শিকার করে। এরা কি সুন্দর উড়তে পারে আবার ডুবে ডুবে সাঁতারও কাটতে পারে। নদীতে সাঁতার কাটতে নামলে আমারও তখন উড়তে ইচ্ছে হয়। উড়তে পারলে মুক্ত ডানা ঝাপটিয়ে সবার আগে এই করতোয়া নদী পাড়ি দিতাম। আমি চিৎকার করি,
'ডানা চাই ডানা চাই, মুক্তি চাই মুক্তি চাই!'
আমার চিৎকার ঈশ্বরের কান অব্দি পৌঁছায় না, নদীর প্রবল স্রোতের শব্দে মিলিয়ে যায়। তাইতো মুক্তি মিলে না। আর্তনাদ যখন ঈশ্বর শুনতে পায় না, আমি তখন কবিতার খাতা বের করি। মুক্তির আকাঙ্ক্ষা আমি কবিতায় লিখে রাখি!
গরু চড়িয়ে সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরি। ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিয়ে যখন চোখ বুজি, পাশের খোপ থেকে ভাতের পাতিল কাঁচানোর শব্দ আসে। সৎ মায়ের সংসার। রাতের খাবারে কোনোদিন পেট পুরে না। ঘুমানোর আগে পাশের খোপ থেকে কানে শব্দ ভাসে, ‛পোলা এতো বড় হইছে, অহনো বাপের ঘাড়ে বইসা অন্ন গিলে। অর হোমাইন্না পোলাপাইন হাওরে ধান কাইট্টা ডেলি দেড়শো টেহা বাপ-মার হাতো দেয়। আর আমার পোড়া কোপাল, ঘরে এমন ডাঙর পোলা থাকতেও দুইডা টেহা পর্যন্ত কামাইয়ের মুখ দেখলাম না।’
বাবা প্রতিদিন একই কথা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যান।
একদিন সকালে ভোরে ঘুম থেকে তুলে আমান কাকার সাথে আমাকে হাওরে পাঠিয়ে দেন ধান কাটতে। সারাদিন ধান কাটি, রাতে গেরোস্তের বাড়িতে থাকি। আমার বদলার টাকা সব আমান কাকার হাতে চলে যায়। ধানকেটে সপ্তাহখানেক বাদে বাড়ি ফেরার সময় আমান কাকাকে বলি,
‛আমার বদলার টাকা আমাকে দিয়ে দাও না কাকা। আমি শহরে যাবো, পড়াশোনা করবো।’
আমান কাকা টাকা দেয় না। বলে,
‛এহনো পড়াশোনা করলে, বাপ-মারে কামাই কইরা খাওয়াবি কবে?’
আমি বলি,
‛স্বপ্ন পূরণ না হলে, কামাই করে কি করবো কাকা?’
কাকা পা চালানো থামিয়ে দেয়। বলে,
‛কামাই করবি বাপ-মারে খাওয়াইতে। ছোডো বেলায় মা মরছে, সৎ মা হইলেও পাইল্লা বড় করছে। এহন বড় হইছস রোজগার করবি, বাপ-মারে খুশি করবি।’
আমি ভয় পাই। তবুও বলি,
‛কাকা আমি পড়াশুনা করবো আরো।’
কাকা চোখ বড় বড় করে তাকায়। বলে,
‛ইন্টার পাস করছস, আর পড়াশোনা দিয়া কি করবি? যা পড়ছস, এইটুকু দিয়াই বীরগঞ্জে মেলা কাজ পাবি।’
আমি আর কিছু বলি না। মাথা নিচু করে হাটা ধরি।
বাড়ি গিয়ে আমার খুব মন খারাপ হয়। আমান কাকা সবগুলো টাকা বাবাকে দিয়ে দেয়। সেদিন চুলায় বড় পাতিলে ভাত রান্না হয়। রাতে পাতিল কাঁচানোর শব্দ কানে ভাসে না। পেট পুরে খাই। পেট ভরপুর থাকলে মেজাজ ফুরফুরে থাকে। মস্তিষ্কে তখন কবিতার লাইন বাসা বাঁধে। কিন্তু ততক্ষণে হারিকেনের তেল ফুরিয়ে যায়। অন্ধকারে কবিতার লাইনগুলো মস্তিস্কেই পুষে রাখি।
হাটের দিনে পাইসা বিল থেকে শাপলা কুঁড়িয়ে আনি। প্রতিমোটা শাপলা একটাকা দরে বিক্রি করি। হাট থেকে ফেরার পথে পেন্সিল আর মোমবাতি কিনে আনি। রাতে হারিকেনের তেল ফুরিয়ে গেলে মোমের আলোয় কবিতা লিখি।
বর্ষাকালে জলাশয়ের পাড় ধরে যখন ডিঙি নৌকা বাই, তখন পাড়ার অল্পবয়সী তরুণীদের দেখা মিলে। জলাশয়ে তখন লাল পদ্ম ফোটে। বুকে উড়না পেঁচিয়ে তরুণীর দল জলাশয়ে নেমে পরে। দু-একটা পদ্ম ছিড়ে চুলের খোঁপায় গুঁজে। মাঝে মাঝে এদের মাথায় টপ টপ বৃষ্টির ফোটা পরে। বৃষ্টির পানি কপালের চুল চুইয়ে চোখের পাঁপড়ি স্পর্শ করে পদ্ম পাতায় পরে। আমি তখন আকাশ ডেকে রাখা মেঘের কথা ভুলে যাই। বৃষ্টিতে নিজে ভিজে যাচ্ছি, সেকথাও ভুলে যাই। আমি শুধু তাকিয়ে থাকি পদ্ম পাতার দিকে। কোনো কিশোরীর চোখে তাকাতে ভীষণ ভয় করে। যদি মুগ্ধতা আমায় স্পর্শ করে ফেলে। ভাবি; কোনোভাবেই জড়ানো যাবে না মুগ্ধতার জালে। মনে প্রেম আসবে প্রকৃতির নিয়মে। যৌবনের ডাকে সাড়া দিয়ে প্রেম মন থেকে পরক্ষনে শরীরে ছেয়ে যাবে। ভীষণ করে কাউকে ছুঁতে ইচ্ছে করবে। প্রকৃতির নিয়ম রুখে দেবার ক্ষমতা তো নেই জানি। কিন্তু ভেবে রাখি, যাবো না আর জলাশয়ের পাড়ে কোনো বর্ষায়। আমার যেইটুকু প্রেম, লিখে রাখি শুধু কবিতার খাতায়। এভাবে একদিন খাতা কবিতায় ভরে যায়। স্থানীয় শালবন পত্রিকা আমার একটি কবিতা ছাপে। বীরগঞ্জে কবিতার প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ে।
শালবনের সম্পাদক আমাকে একদিন নিয়ে গেলেন পাইলট স্কুলের সুবর্ণ জয়ন্তীতে। অনেক বড় করে অনুষ্ঠান হচ্ছে। আমাকে বললেন স্টেজে উঠে কবিতা আবৃত্তি করতে। স্টেজে উঠলাম, নিজের লেখা একটা কবিতা পড়লাম। ঘাড় ঘুরাতেই দেখি এক জোড়া অতি সুন্দর চোখ আমার দিকে তাকিয়ে। একদম জলপ্রপাতের মতো, যেখানে চিরকাল তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। আমার এভাবে চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকা ইচ্ছাকৃত নয়। প্রথম প্রেমে পড়ার অনুভূতি কি এমন হয়? হায় ঈশ্বর! এমন কেনো হলো? আমি তো কখনো প্রেমে পড়তে চাই নি!
চাহনি নামলো, মানুষটার স্নিগ্ধ নরম গলার স্বরে। কবিতার খাতাটার দিকে ইশারা করে বললো,
‛আমাকে একটু দিবা এটা?’
কবিতার খাতা চাওয়াতে আমি অবাক হলাম। বললাম,
‛কেনো?’
খুব আবদারের সুরে বললো,
‛সবগুলো কবিতা পড়েই দিয়ে দিবো। দিবা বলো?’
আমি কবিতার খাতাটা বাড়িয়ে দিলাম। বললাম,
‛আমি চলে যাবো তো। একটু তাড়াতাড়ি দিয়ে দিবেন প্লিজ।’
কবিতার খাতাটা এক হাতে ধরলো। বললো,
‛উহু, আপনি না। তুমি করে বলো।’
আবদারের সুর ছিলো কথায়। হৃদপিন্ডে গাঁথে সে কণ্ঠস্বর। আমি যেনো ক্রমেই দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। মানুষটার সারা শরীরে তাকালাম। ধবধবে ফর্সা ত্বক। কোমর অবধি চুল, সুযোগ পেলেই উড়তে চায়। কপালের চুল এসে কিছুটা মুখ ডেকে দিয়ে যায়। থুতনিতে টোল আছে। আমার প্রেম মন থেকে শরীরে ছেয়ে গেছে। জলপ্রপাত ছেড়ে আমার চোখ গিয়ে থেমেছে গোলাপি ঠোঁটযুগলে! এমন কেনো হলো?
সোনালী পাড়ের হালকা সবুজ সিল্কের শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে থাকা অতি রূপবতী এই মেয়েটির কপালে সিঁদুর আছে! দুহাতে সবুজ কাঁচের চুরির সাথে সাদা রঙের শাখা ঝকঝক করছে। একজন বিবাহিত নারীর সামনে দাঁড়িয়ে মনে প্রেমের আল্পনা আঁকছি! নিজেই লজ্জিত হলাম নিজের উপর। সংকোচ কাটিয়ে বললাম,
‛তুমি বলতে কেমন লাগছে না? বয়স আমার আসলে তেমন না। তাছাড়া আপনি বিবাহিত।’
ব্রু কুঁচকে বললো,
‛বিবাহিত তো? কথা বলবে না? কবিতার খাতা নিয়ে নিবে?’
কণ্ঠস্বরে কিছুটা রাগ, কিছুটা বিরক্তি।
আমি ও তেমন ভাবেই জবাব দিলাম,
‛না, তা কেনো।’
তারপর নীরবতা। কিন্তু নীরবতা আমার ভালো লাগে না। ভালো লাগে মুগ্ধ করতে, হাসাতে, চমকে দিতে। সামনে দাঁড়ানো মানুষটিকে চমকে দিতে হটাৎ দ্রুতবেগে পকেট থেকে হাত বের করে সামনে বাড়িয়ে দিলাম! ‛আচ্ছা আমি মিহির মুহাম্মদ।’
চমকাতে পেরেছি কিনা জানি না, কিন্তু বিস্ময়ের হাসি মানুষটার ঠোঁটে। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করলো, যে স্পর্শে মানুষ হিম হয়ে যায়! ধীরে ধীরে হাসি ঠোঁটের কিনারে ছড়িয়ে পড়লো। খুব আস্তে করে বললো,
‛আমি চিত্রা।’
খুব অল্প সময়েই দারুন সখ্যতা হলো। পাইলট স্কুলের মাঠে সারাদিন দুজনে একসাথে হেসে খেলে কাটিয়ে দিলাম। কবিতার খাতা নিলো ঠিক, পড়লো না। স্কুলের বারান্দায় রেলিংয়ে হেলান দিয়ে বসে ছিলাম দুজন। বললাম,
‛খাতা দিবে না আমার?’
আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে চিত্রা বলে,
‛এখনি চাই খাতা?’
বললাম,
‛না। কিন্তু তুমি যে পড়লে না কবিতা।’
চিত্রা খাতাটা খুলে। বলে,
‛দুর্গোপুজোয় আমার শশুরবাড়িতে এসো। ততোদিনে সবগুলো কবিতা পড়ে শেষ করে রাখবো।’
আমি বললাম,
‛খাতা আনতে তোমার শশুরবাড়ি যাবো?’
‛হুম যাবা। এমনিতে পূজোয় নিমন্ত্রন করলে তো যাবা না। এখন এই কবিতার খাতার জন্য হলেও যাবা।’
চিত্রা এমনভাবে কথাগুলো বললো, ঘাড় কাত করে সম্মতি দেওয়া ছাড়া উপায় ছিলো না। আবার বললো,
‛যাবা তো?’
বললাম, ‛আচ্ছা যাবো।’
চিত্রা উঠে দাঁড়ায়। বলে,
‛শিবরামপুরে, হরিরাজ ব্যানার্জির বাড়িতে। নবমীর দিনে। মনে থাকবে?’
আমি আবার ঘাড় কাত করলাম। যেনো জোর করে সম্মতি নিলো। পুরুষ মানুষের এই এক দুর্বলতা; রূপবতী মেয়েদের কথায় সহজে সম্মতি না দিয়ে পারে না!
চিত্রা চলে গেলে আমি বসে থাকি ওখানেই। কেমন অদ্ভুত লাগছে সবকিছু। সত্যিই কি প্রেমে পড়লাম! কিন্তু কেনো? চিত্রা তো বিবাহিত। স্বামীর সাথে এসেছে সুবর্ণ জয়ন্তীতে। মাঝখানে কেনো শুধু শুধু আমার সাথে পরিচয় হতে হলো। যা আমি ভাবছি, তা হবার নয় কখনো। আমাকে ভুলে যেতে হবে। আজকের দিনটি পুরোপুরি ভুলে যেতে হবে।
বাড়ি এসে চিত্রাকে একরকম ভুলেই যাই। আমি আবার ফিরে যাই করতোয়ার তীরে, রাখাল বালকের বেশে। দুর্গো পূজোর সময় বাড়িতে ফসল উঠে। দিনে ফসল মাড়াই, রাতে ক্লান্ত শরীরে মরা মানুষের মতো ঘুমাই। নবমী চলে যায়, দশমীর দিনে ঢেপা নদীতে দেবী দুর্গার বিসর্জন হয়। তারপর আরো অনেক সময় ফুরিয়ে যায়, শীত আসে। চিত্রার কাছে গিয়ে কবিতার খাতা আনা হয় না। কিন্তু চিত্রাকে মনে পড়ে হটাৎ হটাৎ। আমার এভাবে প্রেমে পড়ার খবর তো ও জানতো না। জানার কথাও না কারণ, প্রেম এখানে অসম্ভব। আমাদের ধর্মটা আলাদা বলে না। কারণটা হলো চিত্রা বিবাহিত। এ দেয়াল টপকানো সম্ভব না। কিন্তু বন্ধু হওয়া যেতে পারতো। চিত্রাও তাই চেয়েছিলো। কিন্তু আমিই কোনো তা হতে দিলাম না? ভেবে দেখলাম, সময় ফুরিয়ে যায় নি তো। সুযোগ আছে ক্ষমা চাওয়ার।
একদিন সকাল ভোরে গায়ে চাদর জড়িয়ে গেলাম শিবরামপুরে। গ্রামে ঢুকেই বুঝলাম, চিত্রা কোনো পুরো ঠিকানা না দিয়ে শুধু হরিরাজ ব্যানার্জির নাম বলে চলে এসেছিলো। বনে সিংহের দলপতিকে যেমন হরিরাজ ডাকা হয়; এই গ্রামেও হরিরাজ ব্যানার্জি তেমনি একজন। ছোট, বড় সবাই তাকে খুব চিনে। কেউ ভয় পায়, কেউ আবার ভীষণ রকমের শ্রদ্ধাও করে। আমার ভয় হয়। বাড়িতে যাবার সাহস করি না। আশেপাশে মানুষের কাছ থেকে খবর নেই। ছোট ছেলে রুপম ব্যানার্জি কলকাতায় আর্ট কলেজে পড়তো। কলকাতা থেকে ফেরার পথে চিত্রাকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গের বড় শহর কলকাতায় বেড়ে উঠা চিত্রা উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি গ্রামে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেনি। পূজোর পরপরই রুপম ব্যানার্জি চিত্রাকে নিয়ে ঢাকায় চলে গেছে। কথাগুলো বলেছিলেন রুপম ব্যানার্জির শৈশবের বন্ধু কেশব বাবু। উনি আমাকে ঢাকায় চিত্রার ঠিকানা যোগাড় করে দিলেন। চিত্রাকে না পেয়ে মন খারাপ হলো। নম্বর যোগাড় করা গেলে টেলিফোনে চিত্রার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া যেতো। এখন সেই সুযোগ নেই। একমাত্র উপায় চিঠি লিখা। ক্ষমা চাইলাম না, কবিতার খাতা ফেরত চেয়ে চিত্রাকে চিঠি লিখলাম। নয় দিন পর উত্তর হাতে পাই। খুব ছোট একটি চিঠি:
‛মিঃ মিহির,
কতো অপেক্ষা করেছি জানো? ঢাকায় আসার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তাকিয়ে ছিলাম পথের দিকে। তুমি আসলে না। খুব রাগ হয়েছিলো। ভেবেছিলাম দেখা হলেও আর কোনোদিনও কথা বলবো না। কিন্তু কি আর করার বলো। তোমার কবিতার খাতাটা পুরোপুরি পড়ে ফেলেছি আমি। একটাও কবিতা নেই। পুরোটা যেনো লাইফ স্টোরি! ঢাকায় আসো শীগ্রই। আমি সব ঠিক করে দিবো। পূজোয় না আসার শাস্তিও অবশ্য দিবো।চিঠি হাতে পেয়েই টেলিফোন করো। বাকিটা টেলিফোনেই বলবো। দেরি করলে শাস্তি বাড়বে। মনে থাকবে?
ইতি
চিত্রা।’
চিঠি পড়ে অনেক ভাবলাম। চিত্রা চিঠির জবাব চায় নি। সরাসরি টেলিফোন করতে বলেছে। ইচ্ছে করলেই বাজারে গিয়ে চিঠিতে দেওয়া নম্বরে টেলিফোন করতে পারি। কিন্তু তার আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ভেবে দেখলাম, যে কবিতার খাতা চিত্রার হাতে সেখানে এক একটা কবিতায় আমার জীবন আঁকা আছে। করতোয়ার পাড়ে বসে বসে যে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা আমি লিখেছি, সবটা চিত্রা জেনে গেছে! জেনে গেছে আমার দুঃখ দুর্দশায় সবটা যাপিত জীবন! যে স্বপ্নগুলো আমি লিখেছি কবিতার খাতায়, তা পূরণ করানোর তাড়না এখন চিত্রার মাথায়! আমি ঢাকায় যেতে চেয়েছি। পড়াশুনা করতে চেয়েছি। কিন্তু এভাবে চাই নি। প্রেমে পড়তে চাই নি। তবুও বন্ধুত্ব নামক সম্পর্কের আড়ালে প্রেমও তো লুকানো সম্ভব। আমার সবটুকু প্রেম নাহয় আবছা আলোয় লুকিয়ে লিখে রাখবো কবিতার খাতায়।
দুদিন পর চিত্রাকে টেলিফোন করি। টেলিফোনে প্রতিটা কথাই মূল্যবান। প্রতি মিনিট ফুরালেই দুটাকা করে কেটে নিবে দোকানী। ওপাশ থেকে ‛হ্যালো’ বলতেই বললাম,
‛চিত্রা আমি আসবো ঢাকায়।’
চিত্রার কণ্ঠে বিস্ময়। বলে,
‛সত্যি? এবার আর ফাঁকি দিবা না তো?’
‛একদম ফাঁকি দিবো না। আর শুনো, সরি হ্যাঁ?’
খানিকক্ষণ নীরবতা। তারপর বলে,
‛চুপ। ক্ষমা করবো না। দেরিতে আসলে শাস্তি বাড়বে।’
টেলিফোনেই হাসি চলে আসে আমার। বলি,
‛ঠিকআছে দিও শাস্তি। ইন্টারের সার্টিফিকেট টা তুলতে পারলেই চলে আসছি।’
চিত্রার কণ্ঠ হটাৎ নেমে যায়। বলে,
‛খুব দ্রুত আসো মিহির। নিঃসঙ্গতা আর ভালো লাগে না!’
‛নিঃসঙ্গতা?’ বলতেই চিত্রা ফোন কেটে দেয়।
আমার মাথায় ঢুকে না চিত্রার জীবনে নিঃসঙ্গতা কিভাবে আসতে পারে। স্বামী সংসার থাকতেও একটা নারীর জীবনে নিঃসঙ্গতা ভর করতে পারে? এই অদ্ভুত একটা প্রশ্নই আমাকে মাতিয়ে রেখেছিলো; মধ্যরাতে একতা এক্সপ্রেসে চড়ে দিনাজপুর ছেড়ে ঢাকায় আসার পথটুকু।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন