কোয়ারেন্টাইন ডায়েরী - 'প্রেম যখন টাইমপাস'
সেটাই লিখবো এখন।
লকডাউনের সময়টা আমি কাটাচ্ছি আমার বড় কাকার বাড়িতে। পুরো এলাকা জুড়ে বিস্তৃত গজারি বাগান। বাড়ির চারপাশে সারি সারি গজারি গাছ। বাড়ির ছাদে উঠলে শুধু সবুজ দেখা যায়। আশেপাশে জনবসতি কম। বলতে গেলে বাড়িটাকে বাগান বাড়ি ও বলা যায়। বাড়ির একপাশে সেগুন বাগান ও আছে। আমার আগ্রহ সবসময় সেগুন বাগানের দিকেই। এই বাড়িতে থাকলে বেশিরভাগ টাইমপাস করি সেগুন বাগানে বসে। কখনো যদি পুরো সকাল এখানে বসে টাইমপাস করি, তখন আমি সেটাকে বলি সকালপাস!
এভাবে সেগুন বাগানে বসে কখনো দুপুরপাস করি, বিকেলপাস ও করি!
আপনারা ভাবছেন; এতো 'পাস' 'পাস' কোনো করছি!
আসলে আমার আজকের মূল গল্পটাই 'টাইমপাস' নিয়ে!
যেটাকে বাংলায় বলে 'সময় অতিবাহিত করা'।
সন্ধ্যা হয় নি এখনো। তবে আকাশ খানিকটা মেঘাচ্ছন্ন। দেখে মনে হচ্ছে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। চৈত্রের শেষের দিকে আকাশ এরকম থাকাটা স্বাভাবিক। কালবৈশাখী ঝড় শুরু হবার দিনগুলো তো খুব নিকটে! চৈত্র মাসে ও অনেক সময় কালবৈশাখীর মতোই ঝড় আসে। তবে সময়টা চৈত্র মাস বলে, আমরা সেটাকে কালবৈশাখী বলতে সাহস করি না। আগে বৈশাখ আসুক তারপর কালবৈশাখী বলা যাবে!
আমার মনোযোগ মূলত কালবৈশাখীর দিকে না। আমি তাকিয়ে আছি সায়মন এর দিকে। প্রায় দুই ঘন্টা যাবত সেগুন বাগানে বসে আছি। এই দুই ঘন্টায় একবার ও কান থেকে ফোন সরায়নি সায়মন! এটা অবশ্য আজ নতুন না। ১৭ দিন যাবৎ এই সেগুন বাগানে বসেই বিকেলপাস করছি, আর প্রতিদিন একই চিত্র দেখছি! ফোন কানে নিয়েই কখনো হাসছে, আবার হুটহাট মুখ বিষন্ন করে কথা বলছে, কখনো গান গেয়ে ও শুনাচ্ছে বিপরীত পাশের মানুষটিকে। আমি ও রোজ মন দিয়ে এসব দেখছি। ভালোই তো; আমার ও টাইমপাস হচ্ছে এসবে!
সায়মন আমার ছোট, তবে বন্ধুর মতো। ঐশী নামক একটি ক্লাসমেট মেয়ের সাথে প্রেম করে। প্রেমের বয়স প্রায় দুই বছর হতে চললো। ওদের প্রেম আছে জানতাম, কিন্তু এতো কথা কখনো বলতে দেখি নি, যা দেখছি এই লকডাউন এর ১৭ দিন যাবৎ! অবসর সময়টা প্রেমিকার সাথে কথা বলে কাটাচ্ছে। এটাকে কি বলে? প্রেম না বলে টাইমপাস বলা যেতে পারে?
আমি রোজ বিকেল বেলা বাগানে বসে অবসর সময় কাটাচ্ছি বসন্তের শেষ বিকেলের পাখির শব্দ শুনে, সেটাকে টাইমপাস বলছি। ব্যস্ত থাকলে অবশ্যই বাগানে বসে টাইমপাস করতাম না। সায়মন ও প্রেম করতো না!
বই নিয়ে ছুটোছুটি করতো অংক স্যারের বাসায়!
সায়মনকেই জিজ্ঞেস করলাম, "কি করছো, প্রেম নাকি টাইমপাস?"
প্রশ্ন শুনে সায়মন আমার দিকে অনেকক্ষণ হা করে তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো; "কি বলছেন আরাফাত ভাই! আপনি জানেন না, আমি ঐশীকে কতো ভালোবাসি? দুই বছর যাবৎ আমরা প্রেম করছি, আর আপনি ভাবলেন কিভাবে, টাইমপাস করছি ওর সাথে?"
আমি এবার হেসে ফেললাম। তারপর বললাম; তুমি তো দুই বছর যাবতই ঐশীর সাথে টাইমপাস করছো!
সায়মনের এবার কেঁদে দেওয়ার মতো অবস্থা হলো। ছেলেটা আমাকে খুবই পছন্দ করে। প্রিয় মানুষের মুখে শুনা অপ্রত্যাশিত কোনো কথা মানুষকে অনেক বেশি কষ্ট দেয়। সায়মন যেনো আমার মুখে এসব কথা বিশ্বাস করতে পারছে না! ও ওর ভালোবাসার প্রমান দিতে উঠে পড়ে লাগলো আমার পিছনে। যেনো, আমাকে বিশ্বাস করাতেই হবে যে, 'ঐশীর সাথে ও টাইমপাস করছে না, প্রেম করছে!'
সায়মনকে এবার শান্ত করে আমার সামনে বসালাম।
কোয়ারেন্টাইন এর দিনগুলোতে তরুণ-তরুণীদের ছড়িয়ে দেওয়া প্রেম কাহিনী থেকে যেই মজার জিনিসটা আবিষ্কার করেছি সেটা বলার একটা সুযোগ ও পেয়ে গেলাম।
সায়মনকে বলতে লাগলাম আমার আবিস্কার করা সেই মজার জিনিসটা:
প্রেম জিনিসটাকে অনেকে অনেক ভাবে দেখে। কেউ ভাবে নিতান্তই শারীরিক আকর্ষণ। কেউ বা ভাবে প্রেম হলো প্রিয় মানুষটির সাথে চূড়ান্ত পরিণতির একটা মাধ্যম। চূড়ান্ত পরিণতি বলতে বিয়ে! প্রেমের আসলে নিজস্ব কোনো সংজ্ঞা নেই।
তবে আমি প্রেমকে নিতান্তই টাইমপাস বললে আমার কথাটা ও আপনি ফেলে দিতে পারবেন না!
আমরা প্রেমে পড়ি, প্রেম করি মূলত নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে একাকীত্বে সঙ্গ পাবার জন্য! দিনশেষে সমস্ত ক্লান্তি মুছে ফেলবার জন্য বরাদ্দকৃত সময়টুকুতে একটা বিশেষ মানুষের সঙ্গ পাবার জন্য!
প্রেমে কোনো সংসার নেই, দায়িত্ববোধ নেই! শরীরে সামান্য জ্বর আসলে মানুষটির জন্য প্যারাসিটামল আনবার তাড়া নেই!
এখানে ভোরের আলো ফুটলে দুজন মানুষের জন্য দিনের খাবার জোগানোর প্রচেষ্টা নেই। প্রেমে আছে;
জ্বরে তেতো হয়ে যাওয়া মুখে খেতে না পারার গল্প বিপরীত মানুষটিকে বলবার তাড়না! আছে দিনের সমস্ত খাবার জোগানো শেষে অবসরে প্রিয় মানুষটির মুখে গল্প শুনার প্রচেষ্টা!
তাহলে কখন প্রেমের আশ্রয় নিচ্ছি?
অবসরে? হ্যাঁ তাই!
আপনি বলবেন, শত ব্যস্ততার মাঝে ও তো প্রেমিক/প্রেমিকার খবর নিচ্ছি! হ্যাঁ, তা করছেন;
কারণ ঐ ব্যস্ততার মাঝে ও আপনার একটু অবসরের প্রয়োজন ছিলো। মস্তিষ্কের বিশ্রামের প্রয়োজন ছিলো। এবং এই অবসর কিংবা বিশ্রামের সময়টুকুতেই আপনি প্রেমের আশ্রয় নিয়েছেন!
প্রেমকে টাইমপাস প্রমান করার জন্য অনেক উদাহরণ দিতে পারবো, কিন্তু সেটুকু সময় হাতে নেই। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। সন্ধ্যাটা এখানে পার করে দিলে এটার আবার নতুন আরেকটা নাম দিতে হবে, 'সন্ধাপাস!'
এদিকে সায়মনকে উৎফুল্ল মনে হচ্ছে। সে কোয়ারেন্টাইনে থাকা তরুণ-তরুণীদেরকে নিয়ে আমার আবিষ্কার করা মজার জিনিসটা জানতে চাচ্ছে।
আমি বললাম, মজার জিনিসটা হলো;
"কোয়ারেন্টাইনে থাকা লাখো তরুণ-তরুণী এই অবসরে 'টাইমপাস' কে প্রেম বলে চালিয়ে দিচ্ছে!'
সায়মনকে পুরোপুরি মানাতে পারলাম না। সে ঐশীর সাথে তার সম্পর্কের নাম দিলো, 'প্রিয় মানুষের সাথে টাইমপাস!'
আরাফাত মহসিন
শিক্ষার্থী,
স্নাতক প্রথম বর্ষ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।
আপনার লেখা গুলো আমার ভালো লাগে।
উত্তরমুছুনমাঝেমধ্যে শেয়ার করি।